আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৯-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

প্রবীণ ভাবনা

বৃদ্ধাশ্রমই কি শেষ আশ্রয়!

বৃদ্ধাশ্রমের বাণিজ্যিক মডেল কী হওয়া উচিত, এ নিয়ে আমাদের এখনও পরিষ্কার ধারণা নেই। অনেক মানুষ বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চাইলে যদি জোগান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না বাড়ে, তাহলে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার খরচই বাড়বে, যা অনেক মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে

| সম্পাদকীয়

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সন্তানদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে এবং এটাই স্বাভাবিক। এই নির্ভরতা যে সবসময় মসৃণ, সুন্দর ও আত্মসম্মান বজায় রেখে হয়ে থাকে, তা নয়। অনেককেই সন্তানের বোঝা হয়ে থাকার গ্লানি নিয়েই বাকি জীবনটুকু বেঁচে থাকতে হয়। তাই আজকাল দূরদর্শী মানুষ পরামর্শ দিয়ে থাকেন, বয়স থাকতে থাকতে সন্তানের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনুন। পরামর্শটি হয়তো অনেক দিক থেকেই বাস্তবসম্মত; কিন্তু তবু কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘোরাঘুরি করতে থাকে।
বয়স্ক বলতে আমরা কাদের বুঝি? দেশকালের তারতম্যে এই সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে অবসরের বয়স বিভিন্ন, আবার ট্রেনে আসন সংরক্ষণের জন্য পুরুষ ও মহিলা বয়স্কের সংজ্ঞাও আলাদা। তবে সাধারণভাবে যদি ষাট বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষকে বয়স্ক ধরা হয়, তাহলে ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য অনুসারে দেশে বয়স্করা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে এরা সারা দেশে এক কোটিরও বেশি। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের বয়স ষাট বা তার ঊর্ধ্বে হবে। এ বয়স্কদের প্রায় বেশিরভাগেরই বয়স ৬০ থেকে ৭০-এর মধ্যে এবং মাত্র ৮ শতাংশের বয়স ৮০-এর বেশি। এটা ঠিক, ষাট বছর পেরিয়ে গেলেও অনেক মানুষ কর্মশীল থাকেন। তবে জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য পরিষেবা, গড় আয়ু বৃদ্ধি ও অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ বয়স্ক জনসংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে, ক্রমবর্ধমান দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণে এদের একটা বড় অংশের নিয়মিত চিকিৎসা ও সেবার প্রয়োজনও বাড়তে থাকে।
এ মুহূর্তে আমাদের বয়স্কদের আর্থসামাজিক অবস্থা কেমন? জাতীয় সমীক্ষার তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের বয়স্ক মানুষের প্রায় ৬৯ শতাংশ বাস করেন গ্রামাঞ্চলে। সারা দেশে বয়স্ক মহিলার সংখ্যা বয়স্ক পুরুষের চেয়ে বেশি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, বয়স্ক মহিলাদের অর্ধেকের বেশি স্বামীহীন-বৈধব্য, বিবাহ-বিচ্ছেদ বা অন্যান্য কারণে, যেখানে বয়স্ক পুরুষদের মাত্র ১৫ শতাংশ স্ত্রীহীন। আর্থিকভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয়Ñ এরকম বয়স্ক সারা দেশে মাত্র এক-চতুর্থাংশ আর অর্ধেকের বেশি বয়স্ক আর্থিকভাবে অন্যের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। কিন্তু সবচেয়ে যেটা লক্ষণীয় তা হলো, বয়স্ক মহিলাদের আর্থিক নির্ভরতা। ৭৩ শতাংশেরও বেশি মহিলা আর্থিকভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রেক্ষিত সারা বাংলাদেশ থেকে বিশেষ আলাদা নয়। প্রায় ৯০ শতাংশ বয়স্কেরই ছেলে সন্তান আছে এবং ছেলেমেয়ে কেউ নেইÑ এরকম বয়স্কের সংখ্যা তুলনায় খুব বেশি নয়। যেসব বয়স্ক লোক আর্থিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল তাদের ৮০ শতাংশেরও বেশি নির্ভর করে থাকেন নিজের ছেলেমেয়েদের ওপর। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই আর্থিক নির্ভরতা শুধু গরিব বয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ নির্ভরতা সচ্ছল পরিবারের মধ্যেও যথেষ্ট। এজওয়েল ফাউন্ডেশনের একটি দেশব্যাপী সমীক্ষায় জানা গেছে, সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও অনেক বয়স্কেরই ইচ্ছামতো খরচের স্বাধীনতা থাকে না।
গ্যারি বেকার একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। তিনি বিতর্কিত, কারণ জন্ম, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা, জটিল গাণিতিক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সন্তানের জন্মের পেছনে মা-বাবার কতটা সচেতন হিসাব-নিকাশ থাকে, তা নিয়ে অনেকেই দ্বিমত হতে পারেন। কিন্তু সন্তানের জন্ম দেওয়া ও তাকে লালন-পালন করার গুণগত মানের যে প্রভেদ করেছেন, তা আমাদের ভাবায়। 
বেবারের তত্ত্ব অনুযায়ী শুধু সন্তানের সংখ্যা নয়, তাদের গুণগত মানও মা-বাবার তৃপ্তির বড় উপাদান। এ গুণগত মান নির্ভর করে মা-বাবা সন্তানকে লালন-পালন করতে কতটা সম্পদ ব্যয় করতে পারছেন তার ওপর। ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়ানো, ভালো টিউশনি ইত্যাদি সবই হলো। তাদের গুণগত মান বৃদ্ধির এ প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে দৌড়াতে সত্যিই কি বেশিরভাগ মা-বাবার কাছে এমন সঞ্চয় অবশিষ্ট থাকে, যা তাদের বৃদ্ধ বয়সের আর্থিক ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করবে? যে সঞ্চয় তাকে ছেলেমেয়ের কোনো সাহায্য ছাড়াই স্বতন্ত্রভাবে বাঁচার স্বাধীনতা দেবে? প্রথমত, বয়স্করা শারীরিক সক্ষমতার বিচারে একরকম নন। বয়স্কদের একটা বড় অংশ যাদের বয়স ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে, তারা অনেকেই কর্মক্ষম। জাতীয় নমুনা অনুযায়ী ৯০ শতাংশেরও বেশি বয়স্ক শারীরিকভাবে সচল। তারা সারা দিন সাহায্য করে যান নিজেদের পরিবারে। নাতি-নাতনিদের সাহচর্য দেওয়া, সাধ্যমতো তাদের দেখাশোনা করা, বাড়ির টুকিটাকি কাজ করা। বাড়িতে বয়স্ক মা-বাবা বা শ্বশুর-শাশুড়ি থাকলে মেয়েদের, বিশেষত যখন তাদের ছোট বাচ্চা থাকে, চাকরি করার জন্য বাড়ির বাইরে বেরুনো অনেক সহজ হয়। আবার যাদের বয়স ৮০-এর ঊর্ধ্বে তারা হয়তো দৈনন্দিন ব্যাপারে অন্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মসর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলেও অনেক ক্ষেত্রেই বয়স্কদের অবদানের একটা বাস্তব দিক আছে।
দ্বিতীয়ত, সরকার বয়স্কদের জন্য জাতীয় চিকিৎসা কর্মসূচির অধীনে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে যেমন সুস্থভাবে বয়স্ক হওয়ার স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কর্মীদের শয্যাশায়ী বয়স্কদের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসার কথা ভাবা হয়েছে, তেমনই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা তার উপরের স্তরের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বয়স্কদের জন্য পৃথক ক্লিনিক ও শয্যাযুক্ত ওয়ার্ডের কথাও বলা হয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব প্রস্তাব সার্বিকভাবে রূপায়িত হলে বয়স্কদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসংক্রান্ত অবস্থার অনেক উন্নতি হবে।
তৃতীয়ত, অনেক বয়স্কই বয়সের একটা ধাপে পৌঁছে স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হন ও যে কোনো সুস্থ বা স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। সে সময়টা যদি তারা ছেলেমেয়ে বা কোনো নিকটাত্মীয়ের কাছে থাকেন, সেটাই হয়তো অনেক সময় অপেক্ষাকৃতভাবে নিরাপদ। বৃদ্ধাশ্রম বয়স্কদের যতই স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে রাখুক না কেন, বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে অনুকূল পরিস্থিতিতে বয়স্করা পরিবারের মধ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করেন।
বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে যতই আশাব্যঞ্জক কথাবার্তা বলা হোক না কেন, বৃদ্ধাশ্রমে বয়স্কদের সঙ্গে খারাপ আচরণের ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি এমন হয় যে, অনেক বেশি বয়স্ক বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চান, তাহলে কি সত্যিই এত বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা করা যাবে? জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ১৯ শতাংশ বয়স্ক একা বা শুধু স্বামী-স্ত্রী বসবাস করেন।
বৃদ্ধাশ্রমের বাণিজ্যিক মডেল কী হওয়া উচিত, এ নিয়ে আমাদের এখনও পরিষ্কার ধারণা নেই। অনেক মানুষ বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চাইলে যদি জোগান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে না বাড়ে, তাহলে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার খরচই বাড়বে, যা অনেক মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।
বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো ও তাদের সমস্যা কমিয়ে আনার জন্য কী কী করা উচিত আর কী কী করা সম্ভব, এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো এককথায় খুব সহজ নয়। মা-বাবা অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কষ্ট করে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে তাদের সন্তানদের বড় করে তোলেন, তাদের প্রতিষ্ঠিত করেন, কাজেই ছেলেমেয়ের উচিত বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার সম্বল হওয়াÑ এই যুক্তির সপক্ষে যতটা আবেগ ও পারিবারিক সামাজিক মূল্যবোধের ছোঁয়া আছে, বাস্তব ও ক্রমপরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতির চিন্তা একেবারেই জীবনযাত্রা আজ শুধু তাদের পরিবারের প্রশ্ন নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অধিকার, আইনের শাসন, সরকারি প্রকল্প ও বাজারের প্রসঙ্গ, তাই আজ এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে সমাজ, রাষ্ট্র ও বাজার সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে। 

আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত