যতই দিন যাচ্ছে, ততই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গবেষণায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উঠে আসছেন অনন্য মাত্রায়। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এবারের গ্রন্থমেলা তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এছাড়া তাকে নিয়ে ১০০ বই প্রকাশের পরিকল্পনাও নিয়েছে বাংলা একাডেমি। বইগুলো প্রকাশিত হবে আগামী তিন বছরে। তবে চলতি বছর মেলায় ২৬টি বই প্রকাশের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় একাডেমি।
মঙ্গলবার মেলা প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করে দেখা যায়, বিভিন্ন পয়েন্টে তার ছবি টাঙানো হয়েছে। স্টল কিংবা প্যাভেলিয়নও বাদ যায়নি। সব জায়গায় তার প্রতি শ্রদ্ধা, আবেগ, ভালোবাসা। জাতির পিতাকে উৎসর্গ করা এ মেলায় তাকে নিয়ে বেশকিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেছে প্রকাশনাগুলো। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই প্রকাশের দিক থেকে চলতি গ্রন্থমেলা ইতঃপূর্বে অনুষ্ঠিত সব মেলাকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্য প্রকাশনাগুলোও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই প্রকাশের দিক থেকে কেন্দ্রে স্থান দিয়েছে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখকরা। প্রায় প্রতিটি স্টলেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই পাওয়া যাচ্ছে।
জানা যায়, চলতি মেলায় সবচেয়ে বেশি বই বিক্রি হচ্ছে ‘আমার দেখা নয়াচীন’। প্রকাশকরা জানান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাঠকের আগ্রহ অনেক বেশি। লেখকরাও এসব বিষয় নিয়ে লেখছেন ভালো। কাকলী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন বলেন, পাঠকের আগ্রহ অনুযায়ী আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই প্রকাশ করি। তাছাড়া দায়িত্ববোধও রয়েছে। এসব বই বিক্রিও হচ্ছে ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ওয়াসিম ইহরাম বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন ভূখ- দিয়েছেন। তাই তাকে নিয়ে জ্ঞানচর্চা দিন দিন বাড়ছে। তরুণ প্রজন্ম তাকে ও তার কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। যার মাধ্যমে ইতিহাসের সঠিক চিত্র তাদের কাছে ফুটে উঠছে। প্রথমা প্রকাশনী জানায়, তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আনিসুল হকের উপন্যাস ‘এখানে থেমো না’। বইটি তাদের প্রকাশনী থেকে সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায় রয়েছে। এছাড়াও মতিউর রহমানের সম্পাদনায় ‘বঙ্গবন্ধু : শ্রদ্ধায় ভাবনায় স্মৃতিতে’ বইটিও ভালো চলছে।
বাংলা একাডেমির সংবাদ সম্মেলন : গ্রন্থমেলায় এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির নিজস্ব বইয়ের বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩১ টাকা ৫০ পয়সা। আর নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ২ হাজার ৪৭৫টি। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী।
মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান : মঙ্গলবার ছিল গ্রন্থমেলার ১৭তম দিন। মেলা চলে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই আসে ১৪৭টি। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী সম্পাদিত ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আমিনুর রহমান সুলতান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাহিদুল হক, জাফর ওয়াজেদ এবং আসলাম সানী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সম্পদ বড়–য়া। প্রাবন্ধিক বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পঁচাত্তর-উত্তর সময়ে প্রগতি ও সুস্থ সংস্কৃতির পক্ষে নিজেদের গড়ে তোলা একদল তরুণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সাহসী হয়ে ওঠেন কবিতা লেখার ভেতর দিয়ে। ঢাকা ও রাজশাহী ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনেও আলোড়ন তুলেছিল। কয়েকজন তরুণ কবি ও রাজনৈতিক কর্মী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এক্ষেত্রে। শোক থেকে শক্তির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশে প্রতিবাদী যে সাহিত্যধারাটি সৃষ্টি হয়, এ ধারার সঙ্গে কবি মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরীর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই সময়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারণ করা যেত না, তখন তারাই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন যৌথ সম্পাদনায়।
আলোচকরা বলেন, বঙ্গবন্ধু নৈতিকতার প্রশ্নে কখনও আপস করেননি। স্বাধীনতার এ মহানায়ক ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেশ এক সংকটময় মুহূর্তে উপনীত হয়। এ নির্মম ও পৈশাচিক হত্যাকা-ের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে জাতির মহাশোককে শক্তিতে রূপান্তরের জন্য সেদিন যাদের কলম সোচ্চার হয়ে ওঠে, তাদের লেখনী সংকলিত হয় গ্রন্থে। একটি জাতির আত্মত্যাগ ও মূল্যবোধের ইতিহাস জানার জন্য এ গ্রন্থ একটি আকরগ্রন্থ হয়ে থাকবে। গ্রন্থের সম্পাদকদ্বয় বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতির জীবনে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়, সে বিভীষিকাময় সময়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করাও একটি সুকঠিন ব্যাপার। কিন্তু সেই সংকটময় সময়েও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে নিঃস্বার্থভাবে আমরা কাজ করে গেছি। বাংলা একাডেমি থেকে পুনর্মুদ্রণের মাধ্যমে এ গ্রন্থটি সত্যিকার অর্থেই মর্যাদার আসন পেল। সভাপতির বক্তব্যে সম্পদ বড়–য়া বলেন, জাতির যে কোনো ক্রান্তিকালে কবিরাই সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকা-ের পর সাহসী প্রতিবাদ তাই ধ্বনিত হয়েছে কবিদের কলমেই; আর সেই প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে রয়েছে এ গ্রন্থটি। এদিন ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন শামীম আজাদ, মলয় বালা, আফসানা বেগম এবং অরবিন্দ চক্রবর্তী।
‘স্থাপনা ধারণা’ প্রদর্শনী : অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে ‘স্থাপনা ধারণা’ প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল এবারের গ্রন্থমেলার উল্লেখযোগ্য সংযোজন। প্রতিযোগীদের উপস্থাপনকৃত স্থাপনাকর্ম নিয়ে গ্রন্থমেলায় বিকাল ৪টায় একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট স্থপতি অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী এবং স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর।
আজকের অনুষ্ঠানসূচি : বুধবার গ্রন্থমেলার ১৮তম দিন। মেলা চলবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জালাল ফিরোজ রচিত বঙ্গবন্ধু গণপরিষদ সংবিধান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মুজতবা আহমেদ মুরশেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ডালেম চন্দ্র বর্মণ, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এবং সাব্বীর আহমেদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।