সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গুটিকয়েক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তাই ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি কমিশন গঠনের বিষয়ে রূপরেখা দিয়েছে সিপিডি।
শনিবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইনে সিপিডি আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশন, সিপিডির প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সংস্থার অপর বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমসহ অন্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। আর লুকিয়ে আছে মূলধন ঘাটতি, নিরাপত্তা সঞ্চিতির মতো আরও অনেক সূচক। এর ফলে মানুষের ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সুদহার নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা দিচ্ছে তার বরখেলাপ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি কমিশন গঠনের বিষয়ে রূপরেখা দিয়েছে সিপিডি। এতে ব্যাংকিং কমিশনের কার্যপিরিধি এবং সম্ভাব্য সুপারিশ ও তার বাস্তবায়নের বিষয় তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, এমন মানুষকে ওই কমিশনে আনতে হবে যাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা ও সততা থাকবে। তারা যাতে নির্মোহভাবে কাজ করতে পারেন সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাদের রাজনৈতিক সমর্থন দিতে হবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তারা যে সুপারিশ করবেন তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক উদ্যোগ থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, সিপিডি এ কমিশনের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ও তাদের মতামত তুলে ধরবে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং কমিশন গঠন বিষয়ে যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে তার বিস্তারিত আমরা এখনও জানি না। গত আট বছর ধরে আমরা ব্যাংকিং কমিশন নিয়ে কথা বলে আসছি। কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য, কার্যপরিধি, কার্যপ্রণালী এবং সুপারিশ কী হতে পারেÑ সে বিষয়ে আমাদের কিছু ধারণা রয়েছে। প্রথমত, কমিশনের কার্যপরিধি সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাতের সঠিক তথ্য পাওয়া এবং পরিসংখ্যানের প্রাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান মূল সমস্যাগুলোর কারণ কী এবং সামনের দিনে চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। চতুর্থত, ব্যাংকিং খাতের সমস্যার জন্য কারা এবং কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী দায়ী তা চিহ্নিত করতে হবে। পঞ্চমত, স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট থেকে প্রশাসনিক ও আইনগত কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তার সুপারিশ তৈরি করা।
তিনি বলেন, একটি সাময়িক কমিশন হিসেবে এর সময় নির্ধারিত থাকতে হবে। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে কাজগুলো শেষ করতে হবে। আগামী জুনে বাজেট আসছে। বাজেটের পরপরই যাতে কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কী পদ্ধতিতে কমিশন কাজ করবে, তার একটি অন্তর্বর্তীমূলক পদক্ষেপ দরকার। সেজন্য ব্যক্তিখাতের কয়েকজন বড় বড় ব্যবসায়ী বা নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে সবার সঙ্গে বসে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোক্তা, সাধারণ গ্রাহক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট-বড় সঞ্চয়কারী, বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, ব্যাংকসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, নারী, যুবক এবং ঢাকার বাইরের জনগণ। অর্থাৎ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল তাদের সবাইকে আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত।
ফাহমিদা আরও বলেন, ব্যাংকিং কমিশনের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। বিভিন্ন সময়েই কমিটি, কমিশন ও তদন্ত কমিশন গঠন হয়ে থাকে। সেগুলোর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে না। এ কারণে এ কমিশন গঠন হলে তাকে পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে। কমিশনের সদস্যদের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সততাই হবে একমাত্র যোগ্যতা। যাতে তারা নির্মোহভাবে প্রভাবের বাইরে থেকে কাজ করতে পারেন। কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। এছাড়া সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন, অর্থাৎ কমিশন যে সুপারিশ দেবে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার দাবি করে অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভারত সরকার এ জাতীয় উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাও এটি করতে পারি। ব্যাংক কমিশন গঠনের উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই। তবে সেই সমর্থন শর্তসাপেক্ষ। শর্তটি হলো এ কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে ব্যাংক খাত নিয়ে একটি কমিশন গঠিত হচ্ছে। আর এ কমিশনের চেয়ারম্যান হচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বুধবার সচিবালয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যাংক কমিশন করব। এজন্য অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলতে হবে। যারা সময় দিতে পারেন, দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারেন, তাদের মধ্য থেকে যে কেউ এ কমিশনের দায়িত্ব নেবেন।’ তিনি স্পষ্ট করে কিছু না বললেও এ নিয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে জানা গেছে।