আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৩-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

পিকেএসএফের উপযুক্ত ঋণ অনেক নারীকে আর্থিক সচ্ছলতা দিয়েছে

অর্থনীতি

এমএ খালেক
| সম্পাদকীয়

পিকেএসএফ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের যে ঋণ প্রদান করা হয় তাকে ‘উপযুক্ত ঋণ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ যার যেটুকু টাকা দরকার তাকে সে পরিমাণ অর্থই প্রদান করা হয়। বেশি টাকা যেমন দেওয়া হয় না, তেমনি প্রয়োজনের তুলনায় কম টাকাও দেওয়া হয় না। এ পদ্ধতিতে ঋণদান কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকর এবং সফল 
বলে প্রতীয়মান হয়েছে

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের নূরজাহান বেগম (৫১) একসময় ভিক্ষা করে সংসার চালাতেন। এতে সংসারের সদস্যদের জন্য দুইবেলা খাবার জোটাতে বেশ কষ্ট হতো। কোনো কোনো দিন তাদের না খেয়ে থাকতে হতো। দরিদ্র হলেও নূরজাহান ছিলেন উদ্যমী নারী। এলাকার এক নারীর মাধ্যমে নূরজাহান বেগম পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) জামানতবিহীন ঋণের বিষয় জানতে পারেন। তিনি পিকেএসএফ থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করে বাড়ির কাছেই একটি ছোট খাবারের দোকান চালু করেন। ‘সমৃদ্ধি ফুড’ নামের দোকানটি অল্প দিনের মধ্যেই বেশ জমে ওঠে। দোকানের উপার্জনের টাকা দিয়ে নূরজাহান বেগম একটি ছোট আকারের ধানের চাতাল গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে চাতালের আয় দিয়ে নূরজাহান বেগম তার ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। নূরজাহানের পরিবার এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল। বাড়িতে পাকা ভবন তৈরি করেছেন। নূরজাহান এখন আত্মনির্ভরতার প্রতীক এবং এলাকায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। 
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে নূরজাহান বেগমের আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনের গল্প বলছিলেন। তিনি বলেন, পিকেএসএফ এবং এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের নারীরা অত্যন্ত সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। তারা সামান্য একটু সহায়তা পেলেই আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। তবে শুধু ঋণ দিলেই একজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন না। এজন্য তাদের ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ, পণ্য ও সেবা উৎপাদন কৌশল, পণ্য বাজারজাতকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। একই সঙ্গে ঋণদানের পর নিবিড় তদারকি করতে হবে। আর ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যেনতেনভাবে টাকা দিলেই হবে না, সে টাকা ব্যবহারের সক্ষমতা তার আছে কি না, প্রদত্ত ঋণের টাকা তার চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত কি না, এসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। এজন্য পিকেএসএফ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের যে ঋণ প্রদান করা হয় তাকে ‘উপযুক্ত ঋণ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ যার যেটুকু টাকা দরকার তাকে সে পরিমাণ অর্থই প্রদান করা হয়। বেশি টাকা যেমন দেওয়া হয় না, তেমনি প্রয়োজনের তুলনায় কম টাকাও দেওয়া হয় না। এ পদ্ধতিতে ঋণদান কার্যক্রম অত্যন্ত কার্যকর এবং সফল বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হচ্ছে। বিআইডিএসএর সাম্প্রতিক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০ সালের প্রথম দিকে ৪২ শতাংশ বাবা-মা তাদের মেয়েদের উদ্যোক্তা হওয়া অথবা এ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতেন। আর এখন এটা ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ অভিভাবকরাও এখন অনুধাবন করতে পেরেছেন, মেয়েদের ঘরে বসিয়ে না রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়। 
নারীদের অনেকেই এখন শুধু চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু ঋণদানকারী সংস্থা এদের অর্থায়ন করছে। একই সঙ্গে সরকারিভাবেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নানারকম সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারের নীতিসহায়তা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একধরনের ইতিবাচক ধারার সৃষ্টি হয়েছে। অতিসম্প্রতি মন্ত্রী পরিষদের এক সভায় এসএমই উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে যাদের ঋণ গ্রহণের জন্য চাহিদাকৃত জামানত দিতে সামর্থ্য ছিল না, তারাও এখন এসএমই ঋণ পাবেন। এ উদ্যোগের ফলে বিশেষ করে দেশের নারী উদ্যোক্তারা অত্যন্ত লাভবান হবেন। কারণ নানা সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক বাস্তবতার কারণে নারী উদ্যোক্তারা ইচ্ছে করলেই ব্যাংকের চাহিদামতো জামানত দিতে পারেন না। তাই সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তারা ব্যাংকঋণ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। অথচ এটা আজ প্রমাণিত যে, নারী উদ্যোক্তারা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে। 
গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) শিল্পের সংজ্ঞায় পরিবর্তন করেছে। আগে এসএমই শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে এ শিল্পে বিনিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ প্রয়োজন হতো অন্তত ৫০ লাখ টাকা। ফলে কুটির শিল্প এবং মাইক্রো শিল্প এসএমই শিল্পের মর্যাদা এবং সুবিধা পেত না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উল্লেখিত সার্কুলারের মাধ্যমে কুটির শিল্প এবং মাইক্রো শিল্পকেও এসএমই সেক্টরের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ সেক্টরের নতুন নামকরণ করা হয়েছে সিএমএসএমই (কটেজ, মাইক্রো স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ)। এর ফলে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলোও এসএমই সেক্টরের জন্য প্রদেয় সব সুবিধা পাবে। কুটির ও মাইক্রো শিল্পকে এসএমই শিল্পের আওতায় নিয়ে আসার ফলে উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হলো। 
চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ‘স্টার্ট আপ বিজনেস’ নামে একটি নতুন খাত সৃষ্টি করে এর জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ অর্থ দিয়ে যারা প্রাথমিকভাবে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চান, তাদের অর্থায়ন করা হবে। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০ হাজার সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তা বাছাই করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এই প্রশিক্ষিত নতুন উদ্যোক্তারা যখন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন, তখন দেশের অর্থনীতিতে একধরনের গতিশীলতা সৃষ্টি হবে। আগামীতে বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাত বিশেষ অবদান রাখবে। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩৩ শতাংশের মতো। এর মধ্যে সিএমএসএমই খাতের অংশীদারিত্ব ২৫ শতাংশ। এটা আরও অনেক বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। 
বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা অত্যন্ত সৃজনশীল ও মেধাবী। তারা যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম। নিকট অতীতেও দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে এসএমই খাত বিশেষ অবদান রেখেছে। পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গেল প্রায় এক দশকে দেশের অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১ কোটি। ২০১০ সালে দেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ, যা বর্তমানে ১ কোটি ৬০ লাখে নেমে এসেছে। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ)। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। এর মধ্যে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা হচ্ছে ১ কোটি ৬০ লাখ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) শর্তানুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হবে। অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তিন শতাংশে নেমে এলেই সেই দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্তির বিষয়ে যেভাবে অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে, তাতে এসডিজির শর্ত পূরণ করতে পারবে বলে আশা করা যায়। আর এ লক্ষ্যার্জনের ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাত বিশেষ অবদান রাখবে। নুরজাহানের মতো নারীরাই আমাদের ভবিষ্যৎ সোনালি স্বপ্ন দেখাবে। হ

ষ পিআইডি ফিচার