একুশে বইমেলার পাঠক বাড়ছে, না কমছে? এটা নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করার খুব প্রয়োজন আছে কি না জানি না। তবে লক্ষ্য করেছি, পাঠকের বৃদ্ধি ও হ্রাস নিয়ে প্রতি বছর শোক-তাপের অভাব হয় না। হায় হায় রবের কমতি হয় না। অবশ্য শুধু বইমেলা চলার সময়ে নয়, সারা বছরই এ আলোচনাটি বইয়ের দোকানে, লেখক আড্ডায়, প্রকাশনের মেলায়, পাঠক আন্দোলনে গমগম করতে দেখা যায়। লেখকদের বলি, বুকে হাত দিয়ে নিজের সৃষ্টিকর্মের দিকে চোখ রাখেনÑ যা আপনি রচনা করলেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণসহ নানা আঙ্গিকে; তা আসলে কতটুকু পাঠযোগ্য! বইমেলায় বইয়ের মান কি আসলে খুশি করতে পারে পাঠককে। পারলে কতটুকু পারে? আদিকাল থেকে আজ অবধি যা শ্রেষ্ঠ, আজ অবধি যা ভালো তা আসলে কতটুকু ভালো? তা কি অনশ্বর? ভালোর কি সত্যি সত্যি কোনো অভেদ্য মাপকাঠি আছে?
বইমেলায় ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, পচা-গলা, কাঁচা-পাকা, স্বাদু-সুস্বাদু, মান-অমানের সব কিছুই উজ্জ্বল রং নিয়ে হাজির হয় দাপটের সঙ্গে। প্রকাশকও জানেন তার দোকানে কোনটা কী। লেখক জানেন কোনটা কী। এক্ষেত্রে পাঠককে সবচেয়ে বেশি জানতে হবে কোনটা কী। উল্লেখ্য বইমেলায় নিয়মিত পাঠক, অনিয়মিত পাঠক, শখের পাঠক, অভিনেতা পাঠক, উৎসাহী পাঠক, অতি উৎসাহী পাঠকসহ হরেক রকম পাঠক ভিড় করে। এক্ষেত্রে পাঠককেই যাচাই-বাছাই করে সংগ্রহ করতে হবে কোনটা টিন, কোনটা ইস্পাত। শখের পাঠক যদি রং দেখে, ছবি দেখে আর মলাট দেখে কিংবা বাহারি নাম দেখে বই সংগ্রহ করেন আর পাঠ করতে গিয়ে দাঁত ভাঙেন; শেষে অভিযোগ করেন তিনি ঠকেছেন, সে দায় যদি এসে প্রকাশক বা বইমেলার ওপর পড়ে, সে দায় কে নেবে? প্রকাশক নাকি লেখক, মেলা কর্তৃপক্ষ নাকি পাঠক নিজেই?
আমি মনে করি, এক্ষেত্রে প্রকাশকের উচিত অপাঠককেও পাঠের কাছে আনার পথ সুগম করা। পাঠকেরও উচিত জেনেশুনে পাঠযোগ্য বই ক্রয় করা। লেখকেরও উচিত এমন কিছু লেখা যা মানুষ পাঠ করে কিছু-না-কিছু পায়। শেখে। হোক সে আনন্দ, হোক সে নিখাঁদ জ্ঞান, হোক সে জানা-শোনার নতুন কিছু। আর যাই হোক, লেখক, প্রকাশক, বইমেলা মিলে পাঠকের মনে যেন ভয় ধরিয়ে দেওয়া না হয়। পাঠকের বিতৃষ্ণায় ক্ষতি নির্দিষ্ট কোনো এক পক্ষের না। এ ক্ষতি সবার।
এবারের বইমেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই শুভকর, সুন্দর, মসৃণ এমনটি কিন্তু নয়। এরপরও প্রশংসা করব, মেলার প্রশস্ততা বৃদ্ধি ও লিটলম্যাগকে বহেড়াতলার কোণ থেকে মূল মেলার সঙ্গে একসঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে। উল্লেখ্য নতুন করে দাবি উঠেছে মেলায় যারা আসেন তাদের গাড়ি পার্কিং করার মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোনো পাশে যদি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তবে তা দর্শনার্থীদের জন্য সুখকর। কয়েকজন মা-পাঠক নিবন্ধকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে জানতে চাইলেন, মেলায় শিশুকে ব্রেস্টফিডিং করানোর মতো কোনো জায়গা আছে কি-না? চোখে-পড়েনি বলে জানাতে পারিনি। থাকলে ভালো। না থাকলে কর্তৃপক্ষ ভাবতে পারেন; যেহেতু অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে এখন একাকার প্রাণের মেলা। মেলা এখন কেবল লেখক, পাঠক আর প্রকাশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়Ñ অমর একুশে গ্রন্থমেলা এখন সর্বসাধারণের মেলায় পরিণত হয়েছে। মেলায় ‘লেখক বলছি’ অনন্য মাত্রা। স্বাধীনতার স্তম্ভসহ লেখক মেলার সঙ্গে যুক্ত করাটা নন্দন তত্ত্বে নান্দনিক। নিরাপত্তাকর্মীদের কিছু অংশ নিরাপত্তার স্বার্থে মেলার ভেতরে ঘুরাফেরা করাটা অবান্তর হবে না। মেলা কর্তৃপক্ষের সজাগ চোখ রাখা বাঞ্চনীয়।
বর্তমানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের অন্তরের সঙ্গে গেঁথে যাওয়া একটা নাম। বইমেলা যে লেখক, পাঠক, প্রকাশকের মেলা এ কথাটিও আজ আর সত্য নয়। এখানে হাজার হাজার দর্শনার্থীও আসেন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষও ভিড় করেন। কারণে-অকারণে তারা মেলায় চষে বেড়ান। আনন্দ-ফুর্তি করেন। সবার সঙ্গে হাই-হ্যালো করেন। নিজে যেমন আনন্দ পান তেমনি অন্যকেও সঙ্গ দেওয়ার মাধ্যমে আনন্দ দেন। এ সাধারণ মানুষগুলো যারা পড়ে না, বই কেনে না, বই বিক্রি করে না, তাদের কি ফেলে দেওয়া সম্ভব? তারা মেলাকে জমিয়ে রাখার একটা অংশ। তাদের যদি খেদিয়ে দেওয়া হয়, তাদের অনুপস্থিতিই বলে দেবে কী ক্ষতির সম্মুখীন হবো আমরা। ভাবনার গভীরে প্রবেশ করলে বুঝা যায়, এদেরও বইমেলায় প্রয়োজন আছে। আছে তাদের বিস্তর অংশীদারিত্ব।
বইমেলা যেন শুধু মেলার আবেশেই বন্দি না থাকে সেদিকটিও গোচরে রাখতে হবে। আয়োজকদের খেয়াল রাখতে হবে, এত বড় আয়োজন কি শুধু অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে, পাঠকের কথা ভেবে, প্রকাশকের টিকে থাকার জন্যে, ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে লালন করার দরকারে? নাকি এই বইমেলা থেকে কোনো ম্যাসেজ ছুড়ে দেওয়ার জন্য? কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে, এতে একটি ম্যাসেজ যেন থাকে। এই মেলায় এসে প্রতিটি মানুষ যেন একটি বার্তা নিয়ে যেতে পারে, যা তাদের মন ও মননকে শানিত করার সক্ষমতা রাখে। আর তাই যদি না হয়, প্রজন্মের হাতে কী তুলে দেওয়া হচ্ছে তা বড় প্রশ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াবে পত্র-পল্লবের শিরায় শিরায়। তখন অনুশোচনার ভার বহন করতে না পারলে তার জন্য কেউ দুঃখ প্রকাশ করবে না। তা কেবল বটের লতাপাতাকেই বহন করতে হবে, না চাইলেও। উৎসাহে আনন্দে এবার ও প্রতিবারই আরও আরও নন্দিত হয়ে উঠুক বইমেলা, প্রাণের বইমেলা। বর্ধিত হোক এর আয়তন, গুণগত মান। এই অমর একুশে বইমেলাÑ বইমেলা একদিন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বের সাহিত্যানুরাগীদের এককেন্দ্রে এনে হাজির করুকÑ এমনটাই বাংলার বাঙালির চাওয়া। হ
জোবায়ের মিলন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী