আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৩-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

বঙ্গবন্ধু : স্বপ্নদ্রষ্টার বাংলাদেশ

মুজিব বর্ষ
| সম্পাদকীয়

সৈয়দ নাজমুল হুদা শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা ও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্ন রচনাকারী। বঙ্গবন্ধু শুধু স্বপ্নই দেখেননি, তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন


নবযৌবনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক কর্মী, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, অকুতোভয় মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের আন্দোলনে যুক্ত না হলেও ভারত-পাকিস্তান দেশটির জন্ম হয়তো বা থেমে যেত না, কিন্তু এই কিংবদন্তির জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ‘১৯৪৭-এর পূর্বে আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল আমরা স্বাধীন হব। কিন্তু ’৪৭ সালেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছি।’ গুজরাটি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আরও আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, মুসলিম লীগ বাঙালির ন্যায্য পাওনা আদায়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক দল হতে পারে না। পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করেন, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও চিন্তা-চেতনায় বাঙালির মুক্তি আসবে না। এরপর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হককে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। নবোদিত শেখ মুজিবুর রহমান বর্ষীয়ান নেতাদের নিয়ে দল শুরু করলেও দলের সব কার্যক্রম পরিচালনায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা ও সিদ্ধান্তকারী হিসেবে কাজ করতেন, যা পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনাবলির মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও দৃঢ় হলো সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে। ধীরে ধীরে মুসলিম জাতীয়তাকে উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয় চেতনা বিকশিত হয়। এর বহির্প্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনি প্রচারণায় যুক্তফ্রন্ট প্রচার করে ২১ দফার একটি ম্যানিফেস্টো। ওই ম্যানিফেস্টোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা এবং পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। এ দাবি উপস্থাপন করেন একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। তখন থেকেই ধর্মভিত্তিকের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এরপর ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়। এভাবে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের নেতাকর্মীরা সাম্প্রদায়িক পরিচয় বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়। ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিজে-এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৫৭ সালের ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এরই মধ্যে শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন, জেল-জুলুম, সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সব ধরনের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব অসুস্থ হয়ে মারা গেলে ২৫ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় বঙ্গবন্ধুকে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা ছয় দফা দাবি পেশ করেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে উদ্দীপক হিসেবে সারা বাংলায় ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গণসংযোগ ও সফর করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ ছাত্র-জনতার সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, শিক্ষক, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীসহ সব বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গ্রহণযোগ্যতা ও মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন দল পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টু ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করে সংঘাতের পথ রচনা করেন। ৩ মার্চ ১৯৭১ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণাটি বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কালের যাত্রাপথে বিভিন্ন সংকটে বিপদে বিপর্যয়ে হিমালয়ের মতো অটল থেকে বাঙালি জাতির জন্য মুক্তির রূপকার হিসেবে নাম লেখান তিনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আর নেতাদের সাহসিকতা ও ত্যাগের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রচিত হয়। শুরু হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির রূপকথার গল্প নয়, বাস্তবতার এক নাম বাংলাদেশ ও শেখ মুজিবুর রহমান। শব্দ দুটি এক ও অভিন্ন। যে কথা না বললেই নয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন ভারত ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দ্রিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের মূল ধারার রাজনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা ও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্ন রচনাকারী। বঙ্গবন্ধু শুধু স্বপ্নই দেখেননি, তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি শোষণ-বৈষম্যমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার দেশের প্রতিটি বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তার কাক্সিক্ষত সোনার বাংলায় দুর্নীতি, অশিক্ষা, বৈষম্য, বেকারত্ব এবং ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান থাকবে না। আজ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯১০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, নারী ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, কৃষিবিপ্লব, রপ্তানি বৃদ্ধি, মানবসম্পদ সৃষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা উন্নীতকরণ, ডিজিটালাইজেশন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৃদ্ধিকরণ, বছরের শুরুতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে স্কুলে নতুন বই বিতরণ চলছে। প্রয়োজন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। করতে হবে মৌলিক সমস্যার সমাধান। সব ক্ষেত্রেই একটি টেকসই ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এসব সমস্যা সমাধান ও তার উপযুক্ত প্রয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন প্রতিটি বাঙালির মধ্যে তুলে ধরতে হবে। ২০২১ সালে হবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অর্থাৎ বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী এবং ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করতে হবে। এভাবেই গড়ে উঠবে প্রতিটি বাঙালির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা, যা এই জন্মশতবার্ষিকীতে এটিই হোক প্রতিটি বাঙালির অঙ্গীকার। হ