যৌন হয়রানি বা ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা ইদানীং দেশের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা ও সচেতন নাগরিকরা উদ্বিগ্ন। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইভটিজিংয়ের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আবেদন জানানো হয়েছে।
ইভটিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আধুনিক মার্কেট ও বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধ বেশিরভাগ সংগঠিত হতে দেখা যায়। নৈতিক শিক্ষার অভাবেই এ জাতীয় অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সুধীমহলের ধারণা। শুধু আইন প্রণয়ন আর তার প্রয়োগেই এ জাতীয় অপরাধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা। কিন্তু পণ্যভোজী ভোগবাদমুখর সভ্যতার যুগে নৈতিক শিক্ষাÑ এ জোড়া শব্দটি একটা অবজ্ঞাসূচক প্রসঙ্গ। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, সমাজজীবনে নৈতিক শিক্ষা প্রায় নিম্নপর্যায়ে। এ সম্বন্ধে কিছু বলতে তাই দ্বিধাগ্রস্ত। এ প্রয়াস সচেতন গুন্ডামি বলে গণ্য হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এই বিশ্বায়নের যুগে ভোগবাদী জীবনস্রোতে গা ভাসিয়ে এবং সনাতন ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে নির্বাসিত করে যে জীবনযাপনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি সেখানে নৈতিক শিক্ষার স্থান কোথায়? সেকেলে জীবনে প্রচলিত রীতিনীতি। হালে অপাঙ্্ক্তেয়। অস্থির ও চঞ্চল আধুনিক যুগে এ নীতিবোধ আঁকড়ে থাকলেও সম্ভাবনাময় জীবনকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। এ ধারণা শুধু ব্যষ্টিতে সীমাবদ্ধ নয়, সমষ্টিতে প্রসারিত। সৎভাবে সরল জীবন যাপন করার মধ্যে যে একটা আলাদা আনন্দ আছে, গোটা আধুনিক জীবনে সম্পূর্ণ অজানা। আমি যা আছি, বেশ আছি। এ জাতীয় ভাবনা যে ভোগমুখী মনে বিশ্রাম ও তৃপ্তি দিয়ে থাকে তা তাদের উপলব্ধিতে নেই।
সুস্থ জীবনযাপনের জন্য আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো যেভাবে অপরিহার্য, নৈতিক স্বাস্থ্য সজীব এবং প্রাণবন্ত রাখা তদ্রƒপ অভিপ্রেত। জীবনে উচ্ছৃঙ্খলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূলে আমরা নিজেরাই। পারিবারিক ও সমাজজীবনের পরিম-ল এবং মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। সেটি তখন সম্ভব হবে যদি আমরা প্রাচীন প্রচলিত রীতিনীতিগুলো সেকেলে বলে জীবন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে না দেই। বর্তমানে এ নীতিবোধ ও নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত বলে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে চলছে মাৎস্যন্যায়। অটুট পারিবারিক বন্ধন, আল্লাহর ভয়, মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল, নিষ্ঠা ও আসক্তি, সংযত ও রুচিশীল পোশাক-পরিচ্ছদ, সমাজ চেতনা, সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে পারস্পরিক ব্যবহার, সহনশীলতা প্রভৃতি রীতিনীতি এককালে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সামগ্রিকভাবে আদৃত হতো। অলিখিত আইনরূপে প্রতিপালিত হতো। পারিবারিক জীবন ছিল তখন নিস্তরঙ্গ। আজকালকার অভিভাবক শিশুদের নৈতিক শিক্ষা কী দেবেন, নিজেরাই এতে বিশ্বাসী নন। ব্যক্তিগত জীবনে তা পালনের প্রয়োজনীয়তা বোধ তো দূরঅস্ত। কিছু কিছু আটপৌরে দৃষ্টান্ত বোধকরি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সদা সত্যাচরণ করার নীতিÑ সূত্রটি কিভাবে বিকৃত হচ্ছে তা দেখা যাক। বাড়িতে আসা কোনো অবাঞ্ছিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে অনাগ্রহী বাবা তার সন্তানটিকে ডেকে বলছেনÑ যা গিয়ে বল, বাবা বাড়িতে নেই। পারিবারিক রেশন কার্ডে চারজনের পরিবর্তে সাতজন দেখানো হচ্ছেÑ শিশুটি তখন হয়তো জিজ্ঞেস করলÑ আমাদের পরিবারে চারজন লোক আছে, সাতজন কিভাবে হলো! বাবা বলছেনÑ তা তুমি বুঝবে না। বেশি রেশন পেতে হলে এরূপ লেখাতে হয়। শিশুটিকে ওই নীতিবাক্যটি শেখালেই যে সে মিথ্যাচরণে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে এর কোনো গ্যারান্টি না থাকলেওÑ এ আদর্শটি সামনে থাকলে সে শতবারের পরিবর্তে হয়তো দশবার মিথ্যাচরণ করবে এবং যখনই করবে তখনই তার মন শঙ্কিত হবে ও এক অপরাধবোধ অনুভব করবে। নীতিবোধের প্রভাব তার ওপর থাকবে। এ মনন আমাদের সমাজের মৃত্তিকাকে চিরকাল সিক্ত ও সজীব রেখেছে।
শিক্ষক ও গুরুজনে শ্রদ্ধাশীল হওয়া আমাদের সমাজে এক সর্বজনগ্রাহ্য ও চিরাচরিত আদর্শ। কিন্তু হালে এই আদর্শটি কিভাবে অবহেলিত হচ্ছেÑ এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি। শিশুটি হয়তো পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। অভিভাবক শিশুটির যোগ্যতা বা পড়াশোনায় অমনোযোগিতার বিচার না করেই শিশুটির সামনে তার প্রধান শিক্ষক ও অন্য শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে অকাতরে বিরূপ মন্তব্য ও অসম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। এমনও অভিভাবক আছেন, যারা স্থান, কাল, পাত্র ভুলে শিশুদের সামনে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে, নিজেদের বাবা-মায়ের প্রতি অশোভন মন্তব্য করতে পিছপা হন না। শিশুরা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেল, তাতে তারা কি কখনও গুরুজনে শ্রদ্ধাশীল হবে? এভাবেই নৈতিক শিক্ষা সমাজ থেকে তাড়িত হচ্ছে।
রক্ষণশীল ও প্রগতিবিরোধী ভর্ৎসনা মেনে নিয়ে বলছিÑ নীতি শিক্ষা বা মর্যাল এডুকেশন আমাদের বিপথগামী সমাজকে পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সমাজে সমৃদ্ধি হয়তো এসেছে, কিন্তু সুখ ও স্বস্তির মুখদর্শন হচ্ছে না। সচেতন থাকা ভালো। চুরি করা মহাপাপÑ এ তৃতীয় দৃষ্টান্তটি বিশেষ তাৎপর্যময়। এ নৈতিক উপদেশটি কি আজকাল পালিত হচ্ছে? দৈনিক পত্রিকা খুললে দেখা যাবেÑ সরকারি-বেসরকারি অর্থের হেরফেরের সাতকাহন। পুকুরচুরির বিস্তারিত বিবরণ। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক কখনও বা শিশুদের বঞ্চিত করে ভোজ্যসামগ্রী আত্মসাতের খবরও আজকাল কাগজে বেরোচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এ জাতীয় আরও অনেক নৈতিক শিক্ষা শিশুদের প্রতিটি পরিবারে দেওয়া হতো, যাতে শিশুগুলোর শিশুবেলা থেকে সুন্দর নৈতিক জীবন গড়ে ওঠে। কিন্তু হালে অর্থ সন্ধানে ধাবমান জীবনে ও আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা, নৈতিকতা বা নীতি শিক্ষার স্থান নেই বললে চলে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ নিজেদেরে যত অত্যাধুনিক বলে বড়াই করে না কেন, সে কখনও অতীতের বাঁধন ছিন্ন করতে পারে না। যখন সে অতীতের দিকে তাকাতে অনীহা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে, তখন সে নিজেকে অন্ধ গলির মধ্যে আবদ্ধ দেখেছে। ভোগবাদী ও আত্মহিতায় নিবেদিত প্রাণ জীবন পদ্ধতিতে মূল্যবোধ সামঞ্জস্যহীন ও বিপথগামী হয়ে পড়েছে। আমরা বুঝতে পারছি না যাকে আমরা অগ্রগতি বলে ধরে নিয়েছি, আসলে তা মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়। যে নীতি শিক্ষা প্রত্যেকটি পারিবারিক জীবনে সুস্থ পরিবেশ ও সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে সেটা আমরা মানতে রাজি নই। নৈতিক জীবন গঠনের চেয়ে আর্থিক সমৃদ্ধি আমাদের কাম্য। ভাবি মর্যালিটি বা নৈতিক শিক্ষা আমাদের অগ্রগতির পথে বাধাস্বরূপ। চারিদিকে যে অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজজীবনকে আতঙ্কিত ও বিপর্যস্ত করে চলেছেÑ তা আমাদের শঙ্কিত করলেও আমরা অসহায়। শিক্ষিত, অতি শিক্ষিত ব্যক্তিও সময় সময় নৈতিকতা দূরে ঠেলে দিয়ে যে দুর্নীতি ও অপরাধ করে যাচ্ছেন তা নিশ্চয় বেদনাদায়ক। জীবনে পাপ-পুণ্য ধারণা বলে কিছু নেই।
আমাদের প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি ছেলেমেয়েকে তাদের বুদ্ধি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এক সুহৃদয় সাহিত্যিকের ভাষায়Ñ মানুষ মাতৃস্তনে যা শিক্ষা লাভ করে, জীবনে তা কখনও বিস্মৃত হয় না। একটি শিশুর চরিত্র গঠন হয় তার জীবনের প্রথম ১৫ বছরে। নৈতিকতা হচ্ছে বিচার-বুদ্ধির সুষ্ঠু প্রয়োগ, যা মানুষের আচরণকে পরিশীলিত করে। বিচার-বুদ্ধি আল্লাহর এক অমূল্য দানÑ যার সঠিক প্রয়োগ মানুষের বন্য প্রকৃতিকে সংযত করে শোধিত করে তার উত্তেজনা ও উচ্ছ্বাস এবং প্রতিষ্ঠিত করে তাকে স্বভূমিকায়। ক্রোধ, লোভ, সর্বস্তরে পরিব্যপ্ত দুর্নীতি, নিষ্ঠুরতা, দ্বেষ, হিংসা, কাম, ধূর্ততাÑ এসবগুলোকে নীতিজ্ঞান বিকাশ করতে সমর্থ। এগুলো যে আমরা জানি না তা নয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে এগুলোর প্রাধান্য লক্ষণীয়। নীতি শিক্ষা মানুষের বিবেককে জাগ্রত রাখে, সে বিবেক যদি জাগ্রত না থাকে, তাহলে সে যে কোনো গর্হিত কাজ করতে দ্বিধাবোধ করবে না। হালে তো তাই হচ্ছে। সভ্যতার মূল ঊদ্দেশ্য যদি মানবকল্যাণ সাধন হয়ে থাকে, তাহলে কিছুসংখ্যক নীতিগত আদর্শবোধ ছাড়া তা হবে না। এ অবস্থায় অস্ট্রিচ পাখির মতো ধুলোতে মুখ থুবড়ে থাকলে চলবে না। নৈতিকতা ধর্ম অথবা কোনো কঠোর নীতিতত্ত্বের সমার্থক নয়। গৃহ এ শিক্ষার প্রকৃত স্থান এবং মা-বাবা এ শিক্ষার আদর্শ শিক্ষক। শুধু বিদ্যালয়ে মর্যাল সায়েন্স বা নীতিশিক্ষা পাঠ্যবিষয়ে সংযোজন করে এ শিক্ষা দেওয়া যাবে না। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, এভাবে পাঠ্য হিসেবে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কেননা সে ক্ষেত্রে বিদ্যার্থীরা নিজেদের জীবনে এগুলোর আচরণের চিন্তা না করে মুখস্থ করে মার্কস পাওয়ার জন্য বেশি তৎপর হয়ে থাকে। ফলে যে উদ্দেশে নীতি শিক্ষার প্রচলন করা, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কাজেই ঘরে মূলত এ শিক্ষা দিতে গেলে মা-বাবাকে ‘আপনি আচারি ধর্ম অপরে শেখাও’ এ আদর্শ অবলম্বন করতে হবে। শুধু শিক্ষিত হলে চলবে না। নৈতিকতার ওপর জীবনের ভিত্তি স্থাপন করতে হবেÑ তা না হলে শিক্ষিত ব্যক্তির অনৈতিক আচরণে শিক্ষার মর্যাদা রক্ষিত হবে না। অধুনা সরকার মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষার পরিবর্তে গ্রেড প্রথা চালু করেছে। শিক্ষাবোর্ডে তা কার্যকরও করা হয়েছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে জোর দেওয়া হতো ছাত্রছাত্রীর পারফরম্যান্সের ওপর, গ্রেড সিস্টেমে এসে যাবে শিক্ষকদের নীতিবোধের প্রশ্ন। তাদের সবার মানসিকতা কি সব ক্ষেত্রে নীতিজ্ঞান সমৃদ্ধ? গ্রেড নিরূপণ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে জাত হারাবে না তো? মর্যাল উপেক্ষিত আধুনিক জীবনে এ জাতীয় প্রশ্ন স্বভাবতই উঠে আসে।
নতুন যুগে নতুন কুশীলবদের নতুন চাহিদা থাকবে এটা স্বাভাবিক। বিশ্বায়নের যুগে সংগতি রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবেÑ সেটা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তাই বলে বাঙালি বা বাংলাদেশীয় পরিবার ও সমাজ থেকে সংস্কার এবং নীতি শিক্ষার অপমৃত্যু ঘটাতে হবে, সেটা ভ্রান্ত ধারণা। আমরা কি একবারও ভাবি অগ্রগতি ও আধুনিকতার আবর্তে আমরা ক্রমে ক্রমে আমাদের জাতীয় সত্তা হারাতে বসেছি। মনে রাখতে হবে, আমাদের ঐতিহ্য ও জীবন ভাবনা অন্য যে কোনো দেশের থেকে একেবারে পৃথক। এ স্বাতন্ত্র্য আমাদের হারানো উচিত হবে না। সত্যি কথা বলতে কি, প্রগতি ও নৈতিকতার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। প্রয়োজন শুধু দুয়ের মধ্যে যথাযথ সমতা রক্ষার মানসিকতা সৃষ্টি। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাসমৃদ্ধ প্রগতি ও নৈতিক দৃঢ়তা এবং নীতি শিক্ষার মর্যাদা দুই-ই আমাদের সংস্কৃতির পরমায়ুর জন্য প্রয়োজন। এ দুইয়ের মিলনেই হতে পারে আমাদের জীবন উদ্ভাসিত। এই সদিচ্ছা কি আবার ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনে জেগে উঠবে, প্রবন্ধকারের এ আবেদন অন্ধের সামনে আরশি ধরার মতো কি নিরর্থক বিবেচিত হবে?
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
১৯.০২.২০২০