আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৬-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

হতাশায় দিন কাটছে সৌদি প্রবাসীদের

বাংলাদেশিদের হাল

রকীবুল হক
| প্রথম পাতা
  • ট্যাক্সের ভারে দিশাহারা 
  • চলছে ধরপাকড় আতঙ্ক
  • দেশে ফেরার সংখ্যা বাড়ছেই

দেশের অন্যতম শ্রমবাজার সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের জীবনযাত্রা ক্রমেই দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। সৌদি সরকার আরোপিত অস্বাভাবিক কর প্রদান, আকামা নবায়নের খরচ বৃদ্ধি, শ্রমিকের বেতন কমে যাওয়া, প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া, পুলিশের ধরপাকড় আতঙ্কÑ সর্বোপরি দেশটির অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসার সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। অনেকে পলাতক জীবনযাপন করছেন। কেউবা পরিবারের সদস্যদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এদিকে এ দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি সংশ্লিষ্ট দালালদের নানা প্রতারণার কারণে সৌদি আরবে যাওয়া নারী শ্রমিকের কেউ কেউ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে। আর সৌদি আরব প্রযুক্তি নির্ভরতা বৃদ্ধি করায় কর্মীর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে দেশটিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।

সূত্র মতে, একসময় সৌদি আরবে ২৭ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে এ সংখ্যা ২২ লাখে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন।

সৌদি থেকে শ্রমিক ফেরতের পরিসংখ্যান প্রসঙ্গে এয়ারপোর্ট ওয়েলফেয়ার ডেস্কের বরাত দিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম হেড শরীফুল ইসলাম হাসান সোমবার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিভিন্ন কারণে গেল বছর সৌদি আরব থেকে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ফেরত এসেছেন। চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার ফেরত এসেছেন।

ফেরত আসার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া, ‘আকামার’ মেয়াদ শেষ হওয়া, ফ্রি ভিসার জটিলতাসহ সৌদিতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেশিরভাগ কর্মী দেশে ফিরে আসছেন। তবে নারী কর্মীদের ফিরে আসার কারণের মধ্যে রয়েছেÑ দেশটির কাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা, কাজের সময় দীর্ঘ হওয়া, ঠিকমতো বেতন না পাওয়া ইত্যাদি।

জেদ্দায় একটি ওয়ার্কশপে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত এক বাংলাদেশি আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, প্রবাসীদের জন্য দেশটিতে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যারা কম বেতনে চাকরি করেন, তাদের অবস্থা ভয়াবহ। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর আকামা রিনিউ করতে লেগেছে ১১ হাজার রিয়াল (আনুমানিক ২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা)। তাছাড়া গত বছর পর্যন্ত মাসিক ৮০০ রিয়াল (ব্যক্তিগত) ট্যাক্স দিতে হয়েছে। এ বছর তা ১ হাজার ১০০ রিয়াল হয়েছে। যারা দোকানদারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করেন, তাদের এ ট্যাক্স দেওয়া লাগে। কোম্পানির অধীনে যারা কর্মরত, তাদের অবশ্য এ ট্যাক্স দেওয়া লাগে না। তিনি বলেন, সম্প্রতি জেদ্দাসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি ধরপাকড় বেড়েছে। আকামা থাক বা না থাক, অনেক বাংলাদেশিকে ধরে জেলে অথবা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া পেশা পরিবর্তন করে অন্য কাজ করলেও পুলিশ ধরছে। বাড়ির কেয়ারটেকার ও হাউজ ড্রাইভারদের ক্ষেত্রে ধরপাকড়ের চাপ বেশি। ফলে বাংলাদেশিদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

মদিনায় একটি বাংলা কমিউনিটি স্কুলে কর্মরত শিক্ষক শহীদুজ্জামান জানান, ট্যাক্স প্রদান, বেতন কম হওয়া ও খরচ বৃদ্ধির কারণে অনেকেই সৌদি থেকে এখন দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। অনেকে পরিবারের সদস্যদের (স্ত্রী-সন্তান) দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন। যে কারণে সৌদিতে বাংলা কমিউনিটি স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে যাচ্ছে। 

সাদিল নামের সৌদি একটি কোম্পানির অধীনে ক্লিনার হিসেবে আরাফাত এলাকায় কর্মরত অবস্থায় কয়েক বাংলাদেশি শ্রমিক জানান, তারা খুবই কষ্টে আছেন। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ঠিকমতো বেতন দেয় না। তাছাড়া বেতনও খুব কম, যা দিয়ে দেশটিতে যাওয়ার খরচ উঠিয়ে পরিবারের জন্য দেশে টাকা পাঠানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাছাড়া নির্জন আরাফাত এলাকায় কাজের সময় খাবার সমস্যাসহ নানা দুর্ভোগে থাকতে হয় বলেও তারা জানান।

সম্প্রতি ওমরা করতে যাওয়া কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে মক্কায় এক মতবিনিময়কালে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেন, ফ্রি ভিসার নামে অনেকে দেশটিতে এসে কাজ না পেয়ে চরম বেকায়দায় পড়েন। একপর্যায়ে এদের পুলিশ ধরে দেশে ফেরত পাঠায়।

তিনি বলেন, ক্লিনার ছাড়া সব পেশার কাজই এখন সৌদিরা করছেন। তাছাড়া দেশটি প্রযুক্তি নির্ভরতা বাড়ানোর কারণে কর্মীর সংখ্যা ব্যাপকহারে কমিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ কাজ অটো মেশিনে হচ্ছে। ফলে আগামীতে বাংলাদেশের জন্য সৌদির শ্রমবাজার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাবে।

এদিকে মহিলা কর্মীদের বিষয়ে ওঠে আসা নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে গোলাম মসিহ বলেন, একজন মহিলা কর্মী পাঠালে সৌদি কোম্পানি থেকে ২ হাজার ডলার (১ লাখ ৭০ হাজার টাকা) দেওয়া হয়। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে অদক্ষ, কম বা বেশি বয়সি, অন্ধ, প্যারালাইসিস রোগী, সাত দিন আগে সিজারিয়ান অপারেশন হওয়া নারীকেও সৌদিতে পাঠানোর নজির পাওয়া গেছে। ফলে এসব নারী সৌদিতে ঠিকমতো কাজ করতে না পারা বা ভাষা বুঝতে না পারার কারণে হয়রানির শিকান হন। এজেন্সি সংশ্লিষ্ট দালালরা এ কাজে জড়িত থাকে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, সৌদিতে ২ লাখ ৫৩ হাজার নারী শ্রমিক কর্মরত। এর মধ্যে নানা কারণে দেশে ফিরে গেছেন ১৭ হাজার। আর এ দুর্নামের প্রভাব কর্মরত আড়াই লক্ষাধিক নারীর ওপর পড়ছে। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।