বক্তৃতা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ
জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। এরপর আলমগীর কবির থেকে তারেক মাসুদ পর্যন্ত বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা এ চলচ্চিত্র ধারাকে এগিয়ে নিয়েছেন। সাহসের সঙ্গে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক অসঙ্গতি, শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রকাশের মাধ্যমে এসব চলচ্চিত্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ সংহত করা, সচেতনতা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন আয়োজিত একক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকালে এ বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়।
ড. নাদির জুনাইদ ‘বাংলা পলিটিক্যাল সিনেমা : প্রটেস্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস সিডনি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই অভিসন্দর্ভের ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার একক বক্তৃতাটি করেছেন ‘ভোক্তা হিসেবে তরুণ সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকা’ শীর্ষক সপ্তম ‘অপ্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ বক্তৃতা’য়।
দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি বলেন, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে দর্শকের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক লাভালাভই থাকে মুখ্য। এ ধরনের চলচ্চিত্র মানুষকে বিদ্যমান সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে হালকা বিনোদনে বিভোর করে রাখে, তাদের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বিপরীতে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার তীক্ষè সমালোচনা তুলে ধরা হয়, ছবির নির্মাণশৈলী হয় প্রথাবিরোধী ও নান্দনিকভাবে উদ্ভাবনী। এ ধরনের ছবির বিষয়বস্তু ও ব্যবহৃত বিভিন্ন কৌশল দর্শকের জন্য অস্বস্তি তৈরি করে, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার তীব্র সমালোচনা তুলে ধরার মাধ্যমে দর্শকের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। পশ্চিম বাংলায় ঋত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সুমন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ও বাংলাদেশে আলমগীর কবির, শেখ নিয়ামত আলী, মসিহউদ্দিন শাকের, সৈয়দ সালাহ্উদ্দীন জাকী, তানভির মোকাম্মেল প্রমুখের চলচ্চিত্রে আমরা দেখি উঠে এসেছে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা।
ঊনিশশ ষাটের দশকে বিভিন্ন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সরকারবিরোধী প্রতিবাদ থাকলেও সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা চলচ্চিত্রে সমকালীন রাজনৈতিক সমস্যার সমালোচনা দেখা যায়নি। জহির রায়হানের চলচ্চিত্রেও উঠে আসেনি রাজনৈতিক প্রতিবাদ। কিন্তু ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় গণআন্দোলন তীব্র ও সর্বব্যাপী হলে তিনি বিদ্যমান বাস্তবতা নিজের ছবিতে উপস্থাপন করতেই আগ্রহী হয়েছেন। সরকারি বাধা উপেক্ষা করেও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করেছেন নতুন ধরনের এক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’, যেখানে রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে স্বৈরশাসনের তীব্র সমালোচনা। বিক্ষুব্ধ এক রাজনৈতিক সময়ে জহির রায়হান সমাজসচেতন একজন শিল্পী হিসেবে নিজের ছবিতে সমকালীন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। একইভাবে পশ্চিম বাংলায় রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময়ে চলচ্চিত্রে সমকালীন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন দুই বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকারÑ সত্যজিৎ রায় আর মৃণাল সেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশে নির্মিত মাটির ময়না ছবিতে নির্মাতা সাহসিকতার সঙ্গে ধর্মীয় অন্ধত্ব আর সাম্প্রদায়িকতার সমালোচনা তুলে ধরেছেন, দীর্ঘদিন টিকে থাকা সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে যুক্তির সঙ্গে বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে তারেক মাসুদ দর্শকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়েছেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। স্বাগত বক্তৃতা দেন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. আহরার আহমদ।