তিনি সামাজিক অনুষঙ্গগুলোকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেছেন সমাজকর্মী ও সমাজচিন্তকের যুগ্ম-অভিজ্ঞানে। সামাজিক বিকারকেও কখনও করে তুলেছেন কবিতার বিষয়। এছাড়া নিসর্গ চেতনা ও মানব প্রজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌন চেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধও তার কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়
আধুনিক বাংলা কবিতা গভীরতর অর্থে ধারণ করে আছে ঐতিহ্যের পরম্পরা। বীরেন মুখার্জির (জন্ম ১৯৬৯) কবিতাও এ ধারাবাহিকতায় ভাস্বর। তার কবিতা মিথ-ঐতিহ্য ও সমকাল ছুঁয়ে যাপনের বিবিধ অনুষঙ্গজারিত; যা বহুস্তরিক চিন্তা উৎসারণকারী, কখনও শূন্যতার ঘোরে নির্বাসনকারী। এছাড়া বাংলাদেশের সমকালীন যন্ত্রণা তার কবিতায় অনন্যমাত্রায় উদ্ভাসিত। স্বদেশের শিল্পিত রূপ ও অকুণ্ঠ ভালোবাসার নিরাভরণ আবেগও তার কবিতার একটি বড় অংশ। সূক্ষ্ম রাজনৈতিক দর্শনও তার কবিতায় উদ্ভাসিত।
নিরন্তর পরিবর্তনশীল মানুষ ও তার স্বপ্ন, কল্পনা, পরাবাস্তবতা, তার অজানা রহস্যময় পৃথিবীর সলুক সন্ধানই যেন তার কবিতার প্রিয় বিষয়। তার ইমেজারি যেন গহিন পাতালের তলদেশ থেকে নেওয়া। তার ভাষা প্রহেলিকাময়, কখনও প্রবঞ্চনাপূর্ণ। তাই তার কবিতা যেন প্রাত্যহিক আলো-আঁধারের বিরোধাভাস হয়ে দেখা দেয়।
তিনি কবিতার পরতে যে স্বপ্ন, বিষাদ, দোদুল্যমানতা ও ঘোর বিনির্মাণ করেছেন, তা সহজেই উবে যাওয়ার মতো নয়। তার কিছু কবিতা কখনও অর্থহীনতা (অনংধফরঃ) তৈরি করলেও তা সুখপাঠ্য ও কবিতাই মনে হয়। যা কবির একধরনের যোগ্যতা হিসেবে চিহ্নায়ন করা যায়।
তার কবিতা একই সঙ্গে স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতা বোধের যুগ্ম-স্বাক্ষর হিসেবে প্রতিভাত। মানবতা, রাজনৈতিক চৈতন্য, ইতিহাসচেতনা ও বাঙালি জাতিগত চেতনার সমন্বয় করে তিনি লোকজ উপাদানকে করে তুলেছেন কবিতার অন্তর্গত। কেবল গ্রামীণ জীবনযাত্রাই নয়, নাগরিক বোধ, প্রকৃতি, নারী, মানবপ্রেম, যৌনচেতনা, অধ্যাত্মবোধ ও মৃত্যুচেতনা-ও তার কবিতার বিপুল অংশে প্রচ্ছন্ন।
তিনি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারেরও রূপান্তর ঘটিয়েছেন। কালজ্ঞান ও ইতিহাস-ঐতিহ্যচেতনার সমন্বয়ে যে কবিতা তিনি বিনির্মাণ করেছেন তা কবিকে করে তুলেছে একই সঙ্গে কালের সাক্ষী, অতীতের ভাষ্যকার ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তিনি সভ্যতার পর্যবেক্ষক, সংস্কৃতির বিশ্লেষকÑ এক কথায় নির্মোহ বিচারক।
তাকে অতিমাত্রায় রোমান্টিক কবি বলার উপায় নেই। রোমান্টিকতা তার কবিতার অন্যতম রং, কিন্তু তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের যে ব্যঞ্জনা ও তার ভেতরে যে অজস্র মণিমুক্তা থরে থরে সাজানো, তা বহুবিধ জীবনের ইঙ্গিতবাহী। মুগ্ধ পাঠক ছাড়া সে জীবনের খোঁজ পাওয়া সত্যিই দুরূহ। এ কারণে তার কবিতা বারবার পাঠ করেই অন্তঃস্থলের সন্ধানে নামতে হয়। আবার এ কথাও সত্য, তার কবিতা প্রথম পাঠেই সঞ্চারিত হয়, ঠিক টিএস এলিয়টের ‘প্রথম পাঠেই সঞ্চারিত হবে’Ñ উক্তিটির মতো। তার কবিতায় উদ্ভাবনঘনিষ্ঠতা যেমন প্রবল, তেমনি তার কবিতা জীবনঘনিষ্ঠও।
তিনি সামাজিক অনুষঙ্গগুলোকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেছেন সমাজকর্মী ও সমাজচিন্তকের যুগ্ম-অভিজ্ঞানে। সামাজিক বিকারকেও কখনও করে তুলেছেন কবিতার বিষয়। এছাড়া নিসর্গ চেতনা ও মানব প্রজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌন চেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধও তার কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
অধীত মনীষা ও আত্মোপলব্ধিজাত অন্তর্নিহিত তাৎপর্যময় চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি অলঙ্কার তার কবিতাকে কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
নিরাশ্রয়ী ও হতোদ্যম মানুষ আশা-নিরাশার দোলাচলে দোলে। তবে চিন্তার সততা ও কল্পনার স্বচ্ছতায় ঐক্য হলেই কেবল মানুষ যূথবদ্ধ ভাবনায় অন্তর্লীন হতে চায়। তখন ব্যক্তি ‘আমি’র উত্তরণ ঘটে নৈর্ব্যক্তিক সত্তায়; বিশেষ ‘আমি’ রূপান্তরিত হয় নির্বিশেষে। তার কবিতার ‘আমি’ও শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য প্রয়োগের কুশলতায় নির্বিশেষে রূপান্তরিত হতে দেখি। কবিতার নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে তিনি যে কাব্যভাষা প্রয়োগ করেছেন তা তাকে বিশিষ্ট ও বিশ্লিষ্ট করেছে তারই সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। তার কবিতার মর্মমূলে ‘ক্ষতদীর্ণ হৃদয়ের আলো-অন্ধকারং’ই তার কবিতাকে ‘জীবনের প্রতিরূপ’ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।