দেশের উন্নয়ন ধরে রাখতে জনসংখ্যা বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকা অতি জরুরি, কেননা সব কিছুই জনসংখ্যার সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান ৪টি, যথাÑ নির্দিষ্ট জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। জনসংখ্যা তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি। আর জনসংখ্যাকে কেন্দ্র করেই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই জনসংখ্যা ছাড়া রাষ্ট্র বা সরকার কল্পনাই করা যায় না। আবার অধিক জনসংখ্যা হাজারো সমস্যার কারণ। সুতরাং জনসংখ্যা কখন একটি দেশের সম্পদ আর কখন সমস্যা, এটা বুঝতে হলে আগে দেশটির আয়তন, অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদ, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, মাতৃমৃত্যুর হার এবং টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা মোট প্রজনন হারের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পলিসি কেমন তা জানা প্রয়োজন।
জনসংখ্যা সমস্যার সৃষ্টি করে তখনই যখন একটি রাষ্ট্রের স্বল্প সীমার মধ্যে অধিক মানুষ বসবাস করে। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় সব কিছুতেই চাহিদা মেটাতে পারে না, আর তখনই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে সম্ভাবনা তৈরি হয় তখন যখন রাষ্ট্র তার জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে পারে, পাশাপাশি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মক্ষম মানুষের কর্মঘণ্টাকে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে পারে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এমনই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হলো একটি রাষ্ট্রের ওইসব কর্মক্ষম জনসংখ্যা যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। যোগ্য নেতৃত্ব আর দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার ফলেই এমনটা সম্ভবÑ তার বাস্তব উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্সসহ অন্য উন্নত দেশ।
নিম্ন ও স্বল্প উন্নত দেশগুলোর অধিক জনসংখ্যা একটি বড় সমস্যা, কারণ ভঙ্গুর অর্থনীতি, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা খাতের অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে খর্বাকৃতি ছেলেমেয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রায় ৩৬ শতাংশ শিশু আজ খর্বাকৃতিÑ যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে। এছাড়া লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে মেয়েদের শারীরিক গঠন বিশেষ করে উচ্চতা দিনে দিনে কমেই যাচ্ছে। তাহলে তাদের সন্তানদের শারীরিক গঠন বা উচ্চতা কেমন হবে?
বাংলাদেশ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গমাইলের একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যার বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। এ দেশটিতে প্রতি বর্গমাইলে ১ হাজার ১১৬ জন বাস করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশ, টিএফআর ২.২ (১ জুলাই ২০১৮, ব্যুরো), নবজাতকের মৃত্যুর হার হাজারে ১৬ জন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৬৩.১ শতাংশ এবং গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭২.৩ বছর হয়েছে (বিবিএস)। উপরিউক্ত সাফল্যের কারণে বাংলদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্যানজিশন-৩ অবস্থান করে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে; যার অর্থ হলো জন্মের হার আর মৃত্যুর হার উভয়ই স্বাভাবিকভাবে কমতে থাকে। বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০৩০ সালের মধ্যে ডেমোগ্রাফিক ট্যানজিশন-৪ অবস্থান করার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যাকে স্থিতিশীল করা।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (টঘউচ) বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেছিল। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১২ কোটি ৯৮ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ। যার এক-তৃতীয়াংশ পরোপুরি বেকার (বিআইডিএস)। তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা সমস্যা না সম্ভাবনা? ডেমোগ্রাফারদের ভাষায়, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি বা সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে এ কর্মক্ষম জনসংখ্যাÑ যার একটা বড় অংশ যুবক।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে এক নম্বর সমস্যা বলে ঘোষণা দেওয়ার পরও জনসংখ্যা নিয়ে আমাদের সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা বা মন্ত্রণালয় নেই। তাই প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার জন্য ‘মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক’ একটি মন্ত্রণালয় গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা মনে করি, মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ দেশের তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে যেমন বিশেষ ভূমিকা পালন করবে; ঠিক তেমনি নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করবে। দেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে ‘মানবসম্পদ উন্নয়নমূলক’ মন্ত্রণালয় গঠন করা জরুরি।
তাই বাংলাদেশের জনসংখ্যার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার। গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বর্ধিত দক্ষ মানবসম্পদ দিয়েই বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই বর্ধিত জনসংখ্যাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে সব সমস্যার কারণ হবে এ জনসংখ্যাই। হ
শিক্ষার্থী
পপুলেশন সায়েন্স, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়