আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৯-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

রুখে দাও মাদক, বাঁচাও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

আনোয়ারুল হক নিজামী
| সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের একটা অংশ ডুবে যাচ্ছে মাদকে, হারিয়ে ফেলছে জীবনীশক্তি। অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে সমাজ জীবনে। মাদকসেবীরা কোথাও কোথাও ভাইকে, মাকে, স্ত্রীকে, বাবাকে পর্যন্ত খুন করছে নেশার ঘোরে কিংবা মাদক কেনার টাকার জন্য 

মাদকের করালগ্রাসে ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এখনই যদি রুখে না দাঁড়ানো যায়, তাহলে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। দেশে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী শিশু, কিশোর ও তরুণ। এরাই আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। মাদক নামক এক ভয়াল আগ্রাসী নেশা ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলছে আমাদের প্রজন্মকে। মাদকের ভয়ানক আসক্তি সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদে নৈতিক অবক্ষয় ঘটাচ্ছে কিংবা ভবিষ্যতেও ঘটাবে। সাধারণত ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেডিন, আফিম, মদ, গাঁজা, ভাংসহ বিভিন্ন নামে এ নেশা বিভিন্নরূপে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলছে।
দার্শনিক রবার্ট ওয়েনের একটি বক্তব্য ছিলÑ ‘মানুষ হয় তেমনি যেমনটা তাকে গড়ে তোলে পরিবেশ। মানুষকে উন্নত করতে হলে সে যেখানে গড়ে ওঠে সেই পরিবেশ বদলানো চাই।’ আসলে আমাদের বিশ্ব-গ্রামের পরিবেশ বদলানো দরকার। বিশ্ব-গ্রামের পরিবেশ বদলানো গেলে আমাদের বাংলাদেশও বদলে যাবে। 
নেশাখোর দিন দিন শীর্ণকায় হয়ে যায়, হাত-পা দুর্বল, ক্ষিদে কম, কাজকর্ম করার মতো শারীরিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিডনি, লিভার, হার্ট বিনষ্ট হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তারুণ্য জীবনের মাঝপথেই। গাঁজা, ভাং, ইয়াবা ধরনের মাদক জীবন নিঃশেষ করে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন মারাত্মক নেশাজাতীয় দ্রব্য। নেশা ধরায় আরও অনেক রকমের মাদক। যেমনÑ হেরোইন, ফেনসিডিল, অ্যালকোহল, তামাকজাত দ্রব্য (জর্দা, গুল, সাদাপাতা) এবং নামে-বেনামে আরও অনেক মাদক।
মিয়ানমারের নির্জন পাহাড়ের ঘন অরণ্যের ভেতরে ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ নামক এলাকা ইয়াবা ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। দেশটির সরকার নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির লোভে এ জঘন্য ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মাদক আরও আসে আফগানিস্তান থেকে। ব্রিটিশরা কয়েক শতাব্দী আগেই বিভিন্ন ধরনের মাদক অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশে প্রচলন করে দিয়েছিল, যাতে প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলে, যেন মাদকাসক্ত হয়ে সারা দিনরাত ঝিম মেরে পড়ে থাকে।
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের একটা অংশ ডুবে যাচ্ছে মাদকে, হারিয়ে ফেলছে জীবনীশক্তি। অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে সমাজ জীবনে। মাদকসেবীরা কোথাও কোথাও ভাইকে, মাকে, স্ত্রীকে, বাবাকে পর্যন্ত খুন করছে নেশার ঘোরে কিংবা মাদক কেনার টাকার জন্য। কলেজছাত্রী ঐশীর কথা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যায়নি, যে মেয়েটি নেশার কারণেই বাবা-মাকে হত্যা করার অপরাধে আদালতের রায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার জন্য অপেক্ষমাণ। শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও চলছে মাদকের নগ্ন আগ্রাসন। চাহিদার ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে মাদক কারবারির সংখ্যাও বাড়ছে সারা দেশে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান সারাবিশ্বে বহু আগে থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে। 
মাদকের ক্ষেত্রেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, যারা মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের মধ্যে কিছু অসাধু ব্যক্তি মাদক-কারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে লিপ্ত। একটি পত্রিকার সংবাদে দেখতে পেলাম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২১৩ জন সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে, যারা মাদকের ব্যবসায় মদদ দিচ্ছে। এ ধরনের অসুখকর খবর জনগণকে উদ্বিগ্ন করে। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। তা হলো, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এককভাবে মাদক নির্মূল করা যাবে না। মাদক থেকে পরিত্রাণের আরও উপায় খুঁজতে হবে। সীমান্তে পাহারা চৌকি তৈরি করে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করার কোনো বিকল্প নেই।  সাংস্কৃতিক-বিনোদন কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি যেমন বৈশাখী মেলা, ফুটবলের সুদিন ফিরিয়ে আনা এবং স্কুল-কলেজের মাঠগুলোকে সবার জন্য মুক্ত করে দেওয়া অপরিহার্য।
শিক্ষক ও মসজিদের ইমামদের মাদকবিরোধী সচেতনতা তৈরিতে সম্পৃক্ত করা। শিশুদের সুন্দর শৈশব উপহার দেওয়া যায় চিত্রাঙ্কনে, নাটকে, বিতর্কে, বৃক্ষরোপণে, গল্প-কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায়, রচনা প্রতিযোগিতায়, গল্পের বই পড়ায়। নিরানন্দ, একঘেয়ে লেখাপড়ার হাত থেকে তাদের মুক্তি দিয়ে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখা খুবই জরুরি। তিন লাখ মসজিদের ছয় লাখ ইমাম মোয়াজ্জিনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তাদের মাদকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বক্তব্য উপস্থাপন করা, পরিবার থেকে সচেতনতা শুরু করা এখন সময়ের দাবি। সন্তানদের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন বাড়াতেই হবে। এজন্য দেশব্যাপী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। 
তরুণ প্রজন্মকে মাদকের অভিশাপ থেকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রজন্ম বাঁচলে জাতি বাঁচবে। অন্যথায় অন্ধকার গহিন অরণ্যে হারিয়ে যাবে জাতীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। হ

মানবাধিকার কর্মী
মিরসরাই, চট্টগ্রাম [email protected]