আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৯-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

বিদ্বেষ মারাত্মক গোনাহ

আশিকুজ্জামান নাঈম
| তাসাউফ

 

হিংসার পথ ধরেই আমাদের মনে আরেকটি রোগ জন্ম নেয়। একে আমরা বিদ্বেষ বলি। এমনিতেই শব্দ দুটি একে অন্যের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। হিংসা যেমন চুলার আগুনের মতো আমাদের নেক আমলগুলো পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি বিদ্বেষও আড়াল হয়ে দাঁড়ায় আমাদের নেক আমলের সামনে। হাদিস শরিফে বিদ্বেষ পোষণকারীদের জন্য সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন উপস্থাপনায়। বিদ্বেষের ভয়বহতা আমরা একটি হাদিস থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব সৃষ্টিকেই ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারীকে ক্ষমা করেন না। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৯০)।
এই হাদিসে দুটি বিষয় লক্ষণীয় : এক. আল্লাহ তায়ালা শবেবরাতে যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তাঁর সব সৃষ্টিই যখন ক্ষমালাভে ধন্য হয়, তখনও বিদ্বেষ পোষণকারী কেউ এ ক্ষমা পাবে না। দুই. বিদ্বেষকারীকে এ হাদিসে মুশরিকদের সহযাত্রী উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ মুশরিককে যেমন ওই রাতে ক্ষমা করা হয় না, তেমনি বিদ্বেষকারীকেও ক্ষমা করা হয় না। মুশরিক তো সে-ই যে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে। আর শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ। এ মুশরিকের সঙ্গে যখন কাউকে জুড়ে দেওয়া হয় তার চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে!
বিদ্বেষকারীর গন্তব্য কোথায় এ ব্যাপারে মুসনাদে আহমদের রেওয়ায়েতে একটি হাদিস এভাবে উল্লেখিত হয়েছেÑ অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা আপন সৃষ্টির দিকে সদয় দৃষ্টিতে তাকান। তখন তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। তবে দু’জনকে নয়Ñ বিদ্বেষ পোষণকারী আর মানুষ হত্যাকারী। (মুসনাদে আহমাদ : ৬৬৪২)।
প্রথম হাদিসে বিদ্বেষকারীর সঙ্গী মুশরিক আর এই হাদিসে বিদ্বেষকারীর সঙ্গী অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকারী। উভয় হাদিস থেকে বুঝে আসে বিদ্বেষ কত মারাত্মক গোনাহ। আর মোমিনকে সবসময় বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। 
এ বিদ্বেষ মানুষের আমল কবুল হওয়ার পথে মস্ত বড় এক দেয়াল। প্রতি সপ্তাহে দুদিন যখন বান্দার যাবতীয় আমল আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়, তখনও বিদ্বেষকারীরা বঞ্চিত। 
এখন কথা হলো বিদ্বেষ কী? খুব সহজ ভাষায় হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বিদ্বেষের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে নিজের অন্তরে কারও প্রতি অশুভ কামনা পোষণ করা আর তাকে কষ্ট দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হচ্ছে বিদ্বেষ। অর্থাৎ কারও সম্পর্কে এমন কামনা করা, সে কষ্টে পড়ুক, তার ক্ষতি হোক, তার ব্যবসায় লোকসান হোক ইত্যাদি। এর সঙ্গে সঙ্গে তাকে কষ্ট দেওয়া এবং ক্ষতি করার তৎপরতা চালানো। আর যদি ওই ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হয়, বা সে কোনো বিপদে পড়ে, তাহলে আনন্দ বোধ করা। 
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদ্বেষের মূলে থাকে ক্রোধ ও ক্ষোভ। কেউ কাউকে কষ্ট দিলে যদি সঙ্গে সঙ্গে সে ওই কষ্টের প্রতিবিধান করতে পারে, প্রতিশোধ নিয়ে নিতে পারে, তাহলে মনে আর ক্রোধ, ক্ষোভ থাকে না। কিন্তু আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যদি কেউ কোনো কারণে প্রতিশোধ নিতে না পারে, তাহলে অন্যায়কারীর প্রতি তার মনে জন্ম নেয় ক্রোধ, ক্ষোভ। হতে পারে সে বয়সে অনেক বড় কিংবা তার ক্ষমতা অনেক বেশি অথবা সমাজের চোখে সে এতটাই মর্যাদাবান যে, আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার কিছুই করতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে কারও কাছে বিচারও প্রার্থনা করা যায় না। এভাবে যখন মনে ক্ষোভ জন্ম নেয়, আর এ ক্ষোভ নিরসনের কোনো পথ সামনে না থাকে, তখনই ক্ষোভ আস্তে আস্তে বিদ্বেষে রূপ নেয়। নিজে প্রতিশোধ নিতে না পারায় এখন প্রতিপক্ষের ক্ষতি কামনা করে। পাশাপাশি এ অপেক্ষায় থাকে, যদি কোনো সময় সুযোগ হয় আমি দেখে নেব! এভাবে বিদ্বেষের কালো মেঘ যখন মনে জমাট বাঁধতে থাকে দিনের পর দিন, এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা পেরিয়ে প্রতিশোধের সুযোগ হাতে আসে, তখন সীমা ছাড়িয়ে এভাবে জালেম হয়ে পড়ার আশঙ্কাই প্রবল। তাই আমাদের কর্তব্য হলো বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকা। 
আমাদের করণীয় : কেউ আমাদের ওপর জুলুম করলে পারলে অনুরূপ বদলা নেওয়া, অন্যথায় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াবের আশায় ক্ষমা করে দেওয়া। আল্লাহ তায়ালা এ ব্যপারে নিজেই এরশাদ করেনÑ মন্দের বদলা অনুরূপ মন্দ। তবে যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধনের চেষ্টা করে তার সওয়াব আল্লাহর জিম্মায় রয়েছে। নিশ্চয়ই তিনি জালেমদের পছন্দ করেন না। যারা নিজেদের ওপর জলুম হওয়ার পর বদলা নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে ও পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। এরূপ লোকদের জন্য আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। আর প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করেÑ এটা বড় হিম্মতের কাজ। (সূরা শূরা : ৪০-৪৩)।
সুতরাং আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার তৌফিকদান করুন। আমিন।