আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ২৯-০২-২০২০ তারিখে পত্রিকা

হতাশার প্রেসক্রিপশন

মুহাম্মাদ মাজিদুর রহমান
| তাসাউফ

 

বর্তমান সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষভাবে যুবক শ্রেণির মধ্যে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাদকাসক্তি। পত্রিকার পাতা খুললে প্রতিদিনই এমন এক-দুটি সংবাদ চোখে পড়ছে, যা একজন চিন্তাশীল মানুষের ঘুম নষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। মা-বাবার আদর-আহ্লাদে বেড়ে ওঠা আদরের দুলাল-দুলালি হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠছে নিজের প্রতি। মা-বাবার আশা-ভরসা, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মুহূর্তেই নিজের জীবনকে নাশ করে দিচ্ছে। কেউ আবার মাদকের ভয়াল থাবার কাছে জীবন সঁপে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। 
সমাজবিজ্ঞানীরা এর কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেনÑ জীবনের প্রতি হতাশা, অপূর্ণ স্বপ্নের আক্ষেপ, চারপাশের মানুষের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করতে না পারার দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থতা ইত্যাদি। কিন্তু এই হতাশা, আক্ষেপ, ব্যর্থতার পেছনের কার্যকারণ হিসেবে কাজ করে বস্তুবাদ। আরেকটু খোলাসা করে বললে, দুনিয়ার জীবনোপকরণ, আরাম-আয়েশ ও এসবের সাজ-সরঞ্জামকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও সফলতার ভিত্তি মনে করা। বস্তুবাদ ও ধর্মহীন সমাজব্যবস্থা যা আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে।  
শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন, ‘ধনসম্পদ মানুষের জীবনে প্রয়োজন; কিন্তু ধনসম্পদের জন্যই জীবন নয়।’ অথচ বর্তমানে আমাদের জীবনাচার দেখলে মনে হবে, জীবনটা শুধুই সম্পদ উপার্জনের জন্য। উপার্জনের এই প্রতিযোগিতা প্রয়োজনের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। উচ্চাশা উচ্চাভিলাষের প্রতিযোগিতায় গিয়ে ঠেকেছে। প্রয়োজন নেই; কিন্তু দামি গাড়ি, খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন, সাজসজ্জার উপকরণ তরুণ-তরুণীদের নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। সেই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অভিভাবক পেরেশান। না পারলে সন্তানের মরা মুখ। কী ভয়ঙ্কর বাস্তবতা! 
মানুষের মনে লোভ, উচ্চাশা, কামনা-বাসনা স্রষ্টা কর্তৃকই প্রদত্ত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘নিশ্চয়ই সে (মানুষ) ধনসম্পদের আসক্তিতে প্রবল।’ (সূরা আদিয়াত : ৮)। এই আসক্তি একটা পর্যায় পর্যন্ত প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু সেটা প্রয়োজন পরিমাণেই সীমাবদ্ধ রাখা জরুরি। নইলে হিতে বিপরীত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানব মনের উচ্চাশার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এভাবেÑ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, একদিন নবীজি (সা.) একটি চতুর্ভুজ আঁকলেন এবং ভুজের একপাশ থেকে মাঝ বরাবর একটি লম্বা রেখা টানলেন, যা ভুজ অতিক্রম করে গেল। তারপর দুই পাশ দিয়ে মাঝের রেখার সঙ্গে মিলিয়ে ভেতরে কয়েকটি ছোট ছোট রেখা টানলেন। এরপর বললেন, এই মাঝের রেখাটি হচ্ছে মানুষ। আর চতুর্ভুজটি তার আয়ু, যা তাকে ঘিরে রেখেছে। আর বাইরের দিকে অতিক্রান্ত রেখাটি তার আশা। ভেতরের এই ছোট ছোট রেখাগুলো বাধা-বিপত্তি। যদি সে এর একটি এড়িয়ে যায়, তবে অন্যটা তাকে দংশন করে। আর অন্যটিও যদি এড়িয়ে যায়, তাহলে আরেকটি তাকে দংশন করে। (বোখারি : ৬৪১৭)। অর্থাৎ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা তার আয়ু থেকেও দীর্ঘ। আর তা পূরণের পথ অত্যন্ত সঙ্গীণ। একটি বাধা অতিক্রম করলে আরেকটি বাধা তাকে থামিয়ে দেয়। দুনিয়ার জীবনটাই এমন। এখানকার সব আশা পূরণ হওয়ার নয়। বরং ইসলামের দৃষ্টিতে তা কাম্যও নয়। 
তাই প্রয়োজন দুনিয়াটাকে বোঝা। এর অসারতা উপলব্ধি করা। দুনিয়ার সামান্য অপ্রাপ্তিতে নিজেকে বিফল মনে না করা এবং আখেরাতের প্রেরণায় জীবন গঠন করা। আমাদের তরুণরা বস্তুজগতের মোহে জীবন শেষ করে দিচ্ছে। অপ্রাপ্তি থেকে তৈরি হচ্ছে হতাশা। অথচ দুনিয়ায় প্রাপ্তি কিছু হাসিল হলেও তা খুবই সীমিত সময়ের জন্য। আখেরাতের তুলনায় যা মূল্যহীন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বরং তোমরা পার্থিব জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখেরাতের জীবনই উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ (সূরা আ’লা : ১৬-১৭)। 
ইমামা গাজালি (রহ.) বলেছেন, দুনিয়ায় যেভাবে ইচ্ছা জীবনযাপন করো! তবে মনে রেখ, একদিন মৃত্যু তোমাকে গ্রাস করবেই। এখানে যাকে ইচ্ছা ভালোবাস! একদিন বিচ্ছেদ ঘটবেই। আর যা ইচ্ছা আমল কর! কেননা এর প্রতিদান তুমি পাবেই।