ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হওয়া বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবার একদিন পর শুরু হলেও নির্দিষ্ট সময়েই শেষ হবে বলে জানা গেছে। ফলে আজই পর্দা নামছে বইমেলার। প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কারণে এবারের গ্রন্থমেলা শুরু হয় ২ ফেব্রুয়ারি থেকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং মেলা শেষ হওয়ার এক দিন আগে হওয়ায় গ্রন্থমেলার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে পাঠক-লেখক-দর্শনার্থীর ভিড়ে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না।
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর সড়ক দ্বীপের মাঝ বরাবর মেট্রোরেলের কাজ চললেও ফুটপাত থেকে শুরু করে রাস্তায় যেটুকু জায়গা আছে, সবখানে মানুষ আর মানুষ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় জনসমুদ্র। সবার গন্তব্য একইÑ অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলায় প্রবেশে দীর্ঘ লাইন। বইমেলার ভেতরেও গিজগিজ করছে মানুষ আর মানুষ। মেলার শেষ শুক্রবার ছিল গতকাল। তাই সকাল থেকেই মেলায় ভিড় ছিল। মেলা শুরু হয়েছিল বেলা ১১টায়। দুপুর ১টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর। এ সময়টাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরে হালুম, ইকরি আর শিকুদের দেখতে শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। দুপুর ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত মেলায় লোকসমাগম কিছুটা কম ছিল। জুমার নামাজ ও মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত ছিলেন বইয়ের ক্রেতারা। দুপুর গড়াতে শুরু করতে না করতেই ঢল নামে মেলায়। বিকাল নাগাদ মেলা টইটম্বুর। শুক্রবারে মেলায় বিক্রিও হয়েছে আশানুরূপ। ক্রেতাদের সামলে বিক্রয় কর্মীদের দম ফেলার ফুরসত নেই যেন। দেখতে দেখতে একদম শেষের দিকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রথম দিন থেকেই দর্শনার্থীর ভিড় থাকলেও মেলায় বেচা-বিক্রি ছিল না তেমন। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বই বিক্রি।
গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, মেলায় আসা বেশিরভাগ দর্শনার্থীর হাতে নতুন কেনা বইয়ের ব্যাগ। কারও দু’হাতে আবার কারও পরিবারের সবার হাতে বইয়ের ব্যাগ। মেলা ঘুরে ঘুরে পর্দা নামছে আজ
ষ শেষ পৃষ্ঠার পর
পছন্দের লেখকের বই কিনছেন তারা। আগে থেকেই পছন্দ করে রাখা বইয়ের পাশাপাশি মেলায় দেখে পছন্দ করে বই কিনছেন অনেকে। বিকালে বইমেলায় এসেছিলেন রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী কবির হোসেন। তিনি বলেন, শেষ সময়ে এসে পাঠকরা বেশি বেশি বই কিনছেন; কারণ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বেশি ছাড় দিচ্ছে। আমি প্রায় ৩০টি বই কিনেছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দু’হাতে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে এক স্টল থেকে আরেক স্টলে ঘুরছিলেন তানজির। আলাপকালে তিনি বলেন, কেবল বই কেনার জন্য সিরাজগঞ্জ থেকে রাতের ট্রেনে ঢাকায় এসেছি। সারা বছর পড়ার জন্য বইগুলো মেলা থেকে সংগ্রহ করব। উদীচীর সদস্য তানহা বলেন, বইমেলার শেষ শুক্রবার ছিল গতকাল। মেলায় যারা এতদিন ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেননি, তাদের অনেকেই আজ এসেছেন। কিনে নিচ্ছেন পছন্দের বই। ছুটির দিন হওয়ায় অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে মেলায় এসেছেন। তাদেরই একজন ইশতিয়াক আলম। তিনি বলেন, স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে মেলায় এসেছি। ওদের জন্য বই কিনব। ছুটির দিনটি মেলায় কাটিয়ে দিতে চাই।
তবে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেক দর্শনার্থী। অসম্পাদিত বইয়ের পাশাপাশি মানহীন গল্প এবং রচনার বই ছেয়ে গেছে মেলা প্রাঙ্গণ। ফলে ভালো বইগুলো জনপ্রিয়তা পায় না বলে অভিযোগ অনেকের। ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আইরিন সুলতানা বলেন, মেলায় মানসম্পন্ন বইয়ের বড় অভাব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রচারণার ফলে এসব বই বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও অসম্পাদিত এবং অতি উৎসাহী নামমাত্র কিছু শৌখিন প্রকাশকরা বই প্রকাশ করছেন। শেষ সময়ের বেচাকেনায় প্রকাশকরাও সন্তুষ্ট। তারা বলছেন, অন্যবারের তুলনায় এবারের বই অনেক মানসম্পন্ন। মুক্তিযুদ্ধের স্টলের কর্মী শুভ বলেন, সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। এর ছোঁয়া লেগেছে মেলায়ও। বইমেলায় এবার মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত বইয়ের চাহিদা বেশি। মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের পাশাপাশি এবারের মেলায় শিশু সাহিত্য, রম্য গল্প, সায়েন্স ফিকশন, ভ্রমণের বই বেশি বিক্রি হয়েছে। যদিও বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্যমতে এবারের মেলায় সবচেয়ে বেশি প্রকাশ হয়েছে কবিতার বই। এর পরপরই আছে গল্প এবং উপন্যাসের বই।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের ইতিহাস নিয়ে দুলাল মাহমুদের লেখা ‘খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি প্রকাশ করেছে বিশ্ব সাহিত্য ভবন; মূল্য ১০০০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে ৩৪ নম্বর প্যাভিলিয়নে। শাহবাগ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত নিয়ে বইমেলায় এফএম শাহীনের লেখা ‘গণজাগরণের দিনগুলি’ প্রকাশ করেছে বাংলা জার্নাল। এটি বইমেলার ৫৩৩ নম্বর স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। অমর একুশে বইমেলায় ‘ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পে’র বিজয়ী লেখক রিয়াজুল আলম শাওনের ‘জনক’ এবং ‘দুঃস্বপ্নের কাল’ নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। জীবনধর্মী উপন্যাস ‘জনক’ প্রকাশ করেছে বর্ষাদুপুর (স্টল ২৩৬-২৩৮), আর হরর কাহিনী ‘দুঃস্বপ্নের কাল’ প্রকাশ করেছে সেবা প্রকাশনী (স্টল ৬৪৮-৬৪৯)।
শিশুপ্রহরে শিশুদের মেলা : বইমেলার শেষ শুক্রবারে শিশুদের কলকাকলীতে মুখর ছিল শিশুপ্রহর। মেলার শেষ সময়ে নিজের পছন্দমতো বই কেনে ছোট্ট সোনামণিরা। অভিভাবকরা মনে করছেন, মাসজুড়ে এ বইমেলার রেশ শিশুদের বইপ্রেমী করে তুলবে। আর শিশুদের মনন অনুযায়ী বই জোগান দিতে পেরে খুশি বই বিক্রেতারাও। গ্রন্থমেলার শিশু চত্বর ঘুরে দেখা যায়, বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুরা নিজের পছন্দের বই দেখছে ও কিনছে। শেষ সময়ে ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে এসেছেন বইমেলায়। শিশু চত্বরে বই কেনার পাশাপাশি আগত সোনামণিরা উপভোগ করছে সিসিমপুরের আয়োজনে বিশেষ পরিবেশনা। শিশুদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাবা-মায়েদেরও বেশ আনন্দ-উদ্দীপনা নিয়ে সিসিমপুরের আয়োজন উপভোগ করতে দেখা গেছে।
ছুটির দিনের সকাল থেকেই শিশুচত্বরে বইয়ের বিকিকিনি ভালো বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন প্রকাশক। এ প্রসঙ্গে পক্সক্ষীরাজ প্রকাশনীর প্রকাশক দেওয়ান আজিজ বলেন, সকাল থেকেই শিশুদের উপস্থিতির পাশাপাশি বইয়ের বিক্রিও বেশ ভালো। মেলা এখন শেষ সময়ে থাকায় যারাই মেলায় আসছেন, তারা সবাই প্রায় বই কিনছেন। আর ছোটদের বইগুলোর মধ্যে গল্পের বইয়ের প্রতিই শিশুদের ঝোঁক বেশি। ছুটির দিন উপলক্ষে মেলা চলে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করে এবারের বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে এবার ২ ফেব্রুয়ারি বিকালে মেলা শুরু হয়, উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লিপইয়ার উপলক্ষে এবার ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনের। তাই আজ রাত ৯টায় পর্দা নামছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এর।