বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয়, কমাতে হবে এবং কমানো সম্ভব বলে জানিয়েছে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। গণশুনানি ও গণস্বাক্ষরের মূল্যায়ন না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় গ্রাহকরা হতাশ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। এদিকে ওয়াসার পানির দাম ছয় মাসের ব্যবধানে আরও ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাগরিকরা।
শুক্রবার দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তেল-গ্যাস-খনিজ-সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানিয়েছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয়, কমাতে হবে এবং কমানো সম্ভব।
বিবৃতিতে বলা হয়, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর আবারও ২৭ ফেব্রুয়ারি সরকারের নির্দেশে বিইআরসি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানিতে প্রদত্ত তথ্য, যুক্তি ও প্রাপ্ত ফলাফলের পরিপন্থি।
‘বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যুক্তিতে বলা হচ্ছে, দেশে গ্যাস সংকটের কারণে তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, সেজন্য দাম বাড়াতে হয়েছে। এ বক্তব্য পুরোপুরি অসত্য। কারণ প্রথমত, গ্যাস সংকটের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ না করে, বেশি ব্যয়বহুল বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের গ্যাস সরবরাহের কারণে এবং অযৌক্তিকভাবে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দেওয়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে।’
তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির নেতারা বলেন, সরকার তার মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬) অনুযায়ী দেশের গ্যাস অনুসন্ধান স্থগিত করে এলএনজি-কয়লা আমদানির পথ ধরেছে, দেশ বিনাশী ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছে, ব্যয়বহুল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে।
তারা বলেন, জাতীয় সক্ষমতা বিপর্যস্ত করে সরকার একদিকে সাগরের গ্যাস ‘বিদ্যুতের দাম কমাতে হবে’
রপ্তানির বিধান রেখে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করছে, অন্যদিকে গ্যাস সংকটের অজুহাতে সুন্দরবন বিনাশী প্রকল্প, ভয়ংকর ঝুঁকি ও বিপুল ঋণের রূপপুর প্রকল্পের উদ্যোগ নিচ্ছে।
‘তেল-গ্যাস-খনিজ-সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কম দামে পরিবেশসম্মতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প মহাপরিকল্পনা করা সত্ত্বেও সরকার তার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতকে ক্রমাগত কিছু দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর ডাকাতি ব্যবসার খাতে পরিণত করছে। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই বারবার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম।’
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সমালোচনা করে নেতারা বলেন, জনসাধারণের অর্থের অপচয় করে নাটক করার জন্য বানানো হয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সেখানে গণশুনানিতে যুক্তি-তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয়, বরং কমানো উচিত এবং তা সম্ভব। কিন্তু সরকারের আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া, দাম বাড়াতেই হবে!
বারবার গ্যাস-বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য বোঝা হচ্ছে, সব পর্যায়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াচ্ছে। সবশেষ এ দাম বৃদ্ধিতে সব পর্যায়ে আরেক দফা উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, বাড়বে বাসা ভাড়াসহ অন্য সব দ্রব্যসামগ্রীর দাম, বাড়বে শিল্পকৃষি পণ্যের দাম, কমবে দেশের অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করে জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাত বিন্যাসের দাবি জানান নেতারা।
শুক্রবার সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, গণশুনানি ও গণস্বাক্ষরের মূল্যায়ন না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় গ্রাহকরা হতাশ। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের বিপক্ষে বিইআরসির গণশুনানিতে গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করে আমরা দাবি করেছিলাম, বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, অপচয় ও অপব্যয় বন্ধ হলে এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের স্বার্থ না দেখলে এর দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। আমাদের দাবি ছিল, বাজারের মূল্য ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত থেকে কমিশন সরে আসবে। পাশাপাশি সাধারণ জনগণের মতামত নেওয়ার উদ্দেশ্যে সপ্তাহব্যাপী মাঠ পর্যায়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচিও আমরা পালন করি। যেখানে হাজার হাজার জনতা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি না করার পক্ষে গণস্বাক্ষর করেন। এরপরও বৃহস্পতিবার কমিশন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষ নিয়েছে।
এদিকে ওয়াসার পানির দাম ছয় মাসের ব্যবধানে আরও ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাগরিকরা। বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে পানির বিল বাড়িয়ে দেওয়ায় বাড়িওয়ালারাও এখন ভাড়া বাড়িয়ে দেবেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পানির দাম বাড়িয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, আবাসিকে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করা হয়েছে। আর বাণিজ্যিক সংযোগে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম ৩৭ টাকা চার পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে।
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ ইয়াসিন সাংবাদিকদের বলেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানিÑ এ তিন সেবার যে-কোনো একটার দাম বাড়লেই বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকরা। আর এখন বিদ্যুৎ-পানি একসঙ্গে বেড়েছে। তিনি বলেন, দেখা গেছে পানির বিল বেড়েছে দুই থেকে তিনশ টাকা। বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এভাবেই দিনের পর দিন চলে আসছে। যতদিন পর্যন্ত সরকারের চার্ট আকারে ভাড়া না আসে, ততদিন এভাবেই চলবে। এজন্য ইউটিলিটি বিল ভাড়াটিয়ারা আলাদা দেবÑ এমন আইন করতে হবে। নাগরিকদের এ ক্ষোভের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, বৃহত্তর সুবিধার জন্য জনগণকে ‘কিছুটা চাপ’ নিতেই হবে। বিকল্প কিছু আমাদের ছিল না। দাম না বাড়ালে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকতে পারবে না। দিন দিন এভাবে চললে প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে যাবে।