শ্রীলঙ্কায় ইসলাম এসেছিল তার আবির্ভাবের শতাব্দী থেকেই। আরবরা সমুদ্রযাত্রায় ছিল পারদর্শী। জাহাজে পাল তুলে ব্যবসা আর ইসলামের প্রচার দুই-ই তারা করেছেন। অষ্টম শতাব্দী থেকেই আরবরা কলম্বোর আশপাশে বসতি গড়ে তুলেছিলেন এ প্রমাণ ইতিহাসে আছে।
ইবনে বতুতা শ্রীলঙ্কা সফরে এসেছিলেন ১৩৪১ থেকে ১৩৪৪-এর মধ্যবর্তী সময়কালে। তিনি তার সফরনামায় কলম্বোর এক মুসলিম রাজার কথা লিখেছিলেন। তার বর্ণনায় ৫০০ আবিসিনিয়ার সে রাজার সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত থাকার উল্লেখ মেলে।
শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন দ্বীপরাজ্যে থাকা এসব মুসলিম ছিলেন সেকালের শ্রীলঙ্কার এলিট এবং স্বভাবতই প্রভাবশালী শ্রেণি। সমুদ্রনির্ভর বিশাল ব্যবসার একচেটিয়া আধিপত্য ছিল তাদের। আর বিশেষ করে রাজকীয় পদ হিসেবে প্রভাবশালী মুসলিম দেশে দূত হিসেবে নিয়োগ পেতেন।
শ্রীলঙ্কার সে সময়কার ইতিহাসে কখনোই সেখানকার মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের প্রমাণ মেলে না। বরং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বিস্তর প্রমাণ আছে। যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি শ্রীলঙ্কায় ছিল, তা দক্ষিণ এশিয়ার তদানীন্তন রাজ্যগুলোর প্রেক্ষিতে অনন্য।
এমনকি মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভারত অভিযানের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা-মুসলিম কূটনৈতিক সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। আরব অভিমুখী আটটি বড় আকৃতির জাহাজ ব্যবসা শেষে ফেরার পথে শ্রীলঙ্কার রাজার পক্ষ থেকে প্রেরিত বহু মূল্যবান উপঢৌকন উমাইয়া খলিফার কাছে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল।
যাওয়ার পথে তারা হামলার শিকার হলে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হাজ্জাজ সিন্ধুতে অভিযান প্রেরণ করেন। এ ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে, শ্রীলঙ্কার রাজশক্তি ও ইসলামি খেলাফতের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল মজবুত।
আদতে শ্রীলঙ্কায় মুসলিমদের ভাগ্যাকাশে কোনো দুর্ভোগের দিন ততদিন পর্যন্ত আসেনি, যতদিন না উপনিবেশবাদীরা শ্রীলঙ্কায় নোঙর করে। ঔপনিবেশিক পর্তুগিজরা শ্রীলঙ্কায় যেহেতু সমুদ্র ও স্থলপথে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল; তাই তারা প্রধান শত্রু হিসেবে মুসলিমদের চিহ্নিত করে। কারণ বাণিজ্য খাত মুসলিম নিয়ন্ত্রাধীন ছিল।
তারা হত্যা, জলদস্যুতা, এমনকি মসজিদগুলোও গুঁড়িয়ে দিতে থাকে। এ সময় কলম্বোসহ বহু অঞ্চলের মুসলমানদের আধুনিক শ্রীলঙ্কার মধ্যভাগ থেকে পূর্বাংশ নিয়ে গড়ে ওঠা ক্যান্ডি সাম্রাজ্য রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। সেসব মুসলিমের প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে অনেককেই খোদ রাজ্যসভায় স্থান দেওয়া হয়।
কর্নাটক ও প্রতিবেশী রাজ্যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরণের প্রমাণ মেলে। এসব ইতিহাস প্রমাণ করে শ্রীলঙ্কার মুসলিম এবং অন্য নাগরিকদের সম্পর্ক বরাবরই ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। শুধু পর্তুগিজ, ডাচ প্রভৃতি ফিরিঙ্গি ঔপনিবেশিকরাই এখানকার মুসলমানদের বিপদে ফেলেছিল। কাজেই ইদানীংকার বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো পেরিয়ে ভবিষ্যতেও সেই সৌহার্দ্য অটুট থাকুকÑ আমরা সেই আশা পোষণ করব।
এ নিয়ে আমার সন্দেহ নেই যে, যারা এককালে শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, আজ সেসব উপনিবেশবাদীদের উত্তরসূরিরাই চায় শ্রীঙ্কার গণমানুষের সঙ্গে দাঙ্গা তৈরি করে শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলমানদের শেষ করতে। শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে এ এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র।
শ্রীলঙ্কায় প্রার্থনা দিবসে, উপাসনালয়গুলোতে হামলা হয়েছে। এ জিনিস মুসলমানদের ব্যথিত করেছে। কারণ যাবতীয় অন্যায়, নিরপরাধ প্রাণের মৃত্যু মুসলমানদের আহত করে। এ ধরনের হত্যাকা- কখনোই কোনো মুসলমান করতে পারে না। শুধু শয়তানের অনুসারীদের দ্বারাই তা হওয়া সম্ভব। কারণ স্বাভাবিক অবস্থায় তো বটেই; যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা, আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার অনুমোদন ইসলামে নেই।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গ করবে না, মৃতের দেহ বিকৃত করবে না, সীমালঙ্ঘন করবে না, শিশু-কিশোরদের হত্যা করবে না, গির্জার অধিবাসী কোনো পাদ্রি-সন্ন্যাসীকে, কোনো মহিলাকে এবং কোনো অতি বৃদ্ধকে হত্যা করবে না।’ (মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকি)।