আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ৭-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

স্বাগতম জাপানের নতুন সম্রাট নারুহিতো

যুবরাজ নারুহিতো জাপানের ১২৬তম সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫৯ বছর বয়সি নারুহিতো অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন এবং মাত্র ২৮ বছর বয়সে জাপানের যুবরাজ হন। বর্তমান সম্রাজ্ঞী মাসাকা ওয়াদা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট। তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী
| সম্পাদকীয়

১ মে ২০১৯ থেকে জাপানের সিংহাসনে নতুন সম্রাট হিসেবে নারুহিতোর আবির্ভাব। ৩০ এপ্রিল ২০১৯ জাপানের রাজ পরিবারের ঐতিহ্যের ছেদ ঘটিয়ে ২০০ বছরের মধ্যে প্রথম সম্রাট হিসেবে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করলেন নারুহিতোর বাবা সম্রাট আকিহিতো। বয়স ও অবনতিশীল স্বাস্থ্যের কারণে নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছিলেন না বিধায় ৮৫ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ বা সিংহাসন ত্যাগ করতে হয়। ১ মে ২০১৯ সম্রাট আকিহিতোর জ্যেষ্ঠ পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ নারুহিতো সিংহাসনে আরোহণ করেন। নারুহিতো এবং তারই স্ত্রী মাসাকো ওয়াদা সম্রাজ্ঞী হিসেবে জাপানের সিংহাসনে অভীষ্ট হলেন। জাপান আজ বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত। রাতারাতি জাপানের এ অবস্থা বদলায়নি। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পরিকল্পিত পদক্ষেপ, দূরদৃষ্টি, কর্মক্ষমতা, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ও ভদ্রতা জাপানকে আজ সাফল্যের স্বর্ণশিখরে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। 
জাপানের সিংহাসনে নতুন সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞী মাসাকা ওয়াদা
যুবরাজ নারুহিতো জাপানের ১২৬তম সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫৯ বছর বয়সি নারুহিতো অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন এবং মাত্র ২৮ বছর বয়সে জাপানের যুবরাজ হন। বর্তমান সম্রাজ্ঞী মাসাকা ওয়াদা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট। তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। স্বভাবে খুবই শান্ত ও দৃঢ়চেতা। তিনি কোনো রাজ পরিবারের মেয়ে নন। তিনি জাপানের শিল্পপতি পরিবারের মেয়ে। ওয়াদার শাশুড়ি সদ্যবিদায়ী সম্রাজ্ঞী মিচিকোও একজন শিল্পপতির মেয়ে। বর্তমান সম্রাটের বাবা আকিহিতো ১৯৫৯ সালে যুবরাজ থাকতে সাধারণ পরিবারের মেয়ে মিচিকোকে বিয়ে করেছিলেন। সে জন্য বলা হয়, জাপান রাজ পরিবারের জন্য আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন আকিহিতো। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর বর্তমান সম্রাজ্ঞী মাসাকো ওয়াদা যুক্তরাষ্ট্রে লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব লাভ করা সত্ত্বেও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। তিনি দেশের জন্য কাজ করতে বেশি উৎসাহ বোধ করেন। ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরে এসে আরও অনেক ডিগ্রি লাভের পর টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। সেখানে তিনজন পরীক্ষায় উত্তীর্ণের মধ্যে তিনিও একজন। ছয় মাস পর জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির জন্য পরীক্ষায় ৮০০ জনের মাঝে মাত্র ৩০ জন সফল প্রার্থীর মধ্যে সম্রাজ্ঞী মাসাকো ওয়াদা ছিলেন অন্যতম। ওয়াদা স্কি, টেনিস, বাস্কেটবল খেলতে ভালোবাসেন। তিনি নম্র-ভদ্র, শান্ত, ধীরস্থির, কূটনৈতিক ও বুদ্ধিমতি। আস্থাবোধ ও সিরিয়াসনেস তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং দুর্লভ ব্যক্তিত্বের ও দয়ামায়া এবং মানবিক গুণের অধিকারিণী তিনি।
যুবরাজ থাকা অবস্থায় বর্তমান সম্রাট নারুহিতোর জন্য ৬ বছর ধরে কনে খোঁজা হয়। রাজপ্রাসাদ কর্মীরা ১০০ তরুণীকে সম্ভাব্য কনে হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু নারুহিতো সব মেয়েকে নাকচ করে দেন। কারণ তিনি ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম ওয়াদাকে দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। একটি চায়ের আসরে বর্তমান সম্রাজ্ঞী ওয়াদার সঙ্গে বর্তমান সম্রাট নারুহিতোর পরিচয়ের সূত্রপাত্র ঘটে। ওই বছরই তাদের ‘বাগদান’ হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩-তে তাদের বিয়ের পর এ দম্পতির একমাত্র মেয়ে প্রিন্সেস আইকোর জন্ম হয় ২০০১ সালে। যদিও জাপানের বর্তমান আইন অনুসারে কোনো নারী সিংহাসনে বসতে পারেন না, যে কারণে প্রিন্সেস আইকো সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী নন। সম্রাট নারুহিতোর পর উত্তরাধিকারীর তালিকায় রয়েছেন তার ছোট ভাই ফুমিহিতো। এর পর রয়েছেন ফুমিহিতোর সন্তান হিসাহিতো। জাপানের সম্রাটের যদিও কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই; তবু তাকে জাতীয় প্রতীক হিসেবে জাপানিরা দেখে থাকে। সম্রাট আকিহিতোর দায়িত্ব ত্যাগ ও নতুন সম্রাট নারুহিতোর দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠান বা আয়োজনটা উৎসবের মতো আকার ধারণ করেছিল জাপানে। অথচ ৩০ বছর আগে যখন আকিহিতো তার বাবার মৃত্যুর পর সম্রাট হন, তখন গোটা দেশ (জাপান) শোকের সাগরে ভাসছিল। জাপানের রাজবংশ বিশ্বের পুরোনো রাজকীয় পরিবার। পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে থেকে এ রাজতন্ত্র চলছে। একসময় জাপানের সম্রাটদের ঈশ্বরের মতো করে দেখা হতো। তবে সম্রাট আকিহিতোর বাবা অর্থাৎ নতুন সম্রাট নারুহিতোর দাদা সম্রাট হিরোহিতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পর তার সেই দেবত্ব ত্যাগ করেন। 
১৯৮৫ সালে জাপানের আকাসাকা রাজকীয় প্রাসাদে জাপানের বিদায়ী সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকোর সঙ্গে বাংলাদেশ-জাপান যুব মৈত্রী সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের যুব প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখনই আমাকে জানানো হয়েছিল, আকাসাকা প্রাসাদের ভেতরে রাজকীয়দের সঙ্গে দেখা করার সময় পকেটে হাত রাখা যাবে না এবং হাত তুলে কথা বলা নিষেধ ইত্যাদি। সাক্ষাতের সময় তৎকালীন সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো বাংলাদেশের বন্যা, দারিদ্র্য, ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, জাপান সবসময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। কেননা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি জাপানের দুর্বলতা রয়েছে। তারা যুবরাজ ও যুবরাজ্ঞী থাকার সময় ১৯৭৫ সালের ২১-২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা উভয়েই বাংলাদেশ ও জাপানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদারের কথা ব্যক্ত করি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের হাজারো তরুণ একসময় জাপানে চাকরির সুবাদে গিয়ে আজ দেশে প্রতিষ্ঠিত। আশা করি জাপানের নতুন সম্রাট নারুহিতোর আগমনের ফলে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার সুসম্পর্ক আরও চমৎকার হবে। জাপানের নতুন সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞী মাসাকো ওয়াদার সাফল্য ও দীর্ঘজীবন কামনা করি। হ

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী 
গণমাধ্যমকর্মী ও বাংলাদেশ-জাপান যুব মৈত্রী সমিতির সভাপতি