নাজমুল হুদা
ফ্রান্স সামুদ্রিক অঞ্চলে ঘেরা পশ্চিম ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশটিতে মুসলিম বসবাসকারীর সংখ্যা শতকরা পাঁচভাগের কিছু বেশি। ধর্ম পালনে নানা বিষয়ে বিধিনিষেধ কিংবা বাধ্যবাধকতা থাকলেও রমজানে রোজা ও অন্যান্য ইবাদতে এখানকার মুসলমানরা কিছুটা নিরাপদ ও স্বাধীন। পবিত্র রমজানের আগমনে ফ্রান্স জনবসতির বিস্তৃতির মতোই প্যারিসের মুসলিম বসবাসস্থল ‘বারবিস’ এর পুরো এলাকাজুড়ে রোজার আমেজ ও পরিবেশ বিরাজ করে, যা আরব ও মুসলিম দেশগুলোর রমজানের চিত্র স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি বিশাল লোকসমাগমে সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সের নারী-পুরুষ একত্রিত হয়, যেখানে বিক্রেতারা মিষ্টান্ন ও রমজানের দ্রব্যসামগ্রী প্রদর্শন ও বিক্রয় করে থাকেন। এছাড়া মুসলিম নারীরা মাঝ সড়কের বিভিন্ন স্থানে সুস্বাদু ও সুঘ্রাণযুক্ত হরেক রকমের ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেন। অন্যদিকে আরব ও মুসলিম ইউনিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়।
প্যারিসের নিচু এলাকার ‘নানতি’ নামক শহরের গোশত বিতানগুলোতে হালাল ও তরতাজা গোশত সংগ্রহে বেশ সংখ্যক ক্রেতা দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। আহমদ নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘এ মাসে গোশতের মতো সুস্বাদু পণ্য সংগ্রহকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়।’
দোকানগুলো ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু যেমনÑ দুধ, শাবাকিয়াহর মতো এক ধরনের পিঠা ও ইফতার সামগ্রী প্রদর্শন করে থাকে। এছাড়াও মরক্কোর ‘হারিরি’ নামক এক ধরনের মজাদার ‘সুপ’ এবং তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও মরক্কোর প্রসিদ্ধ এক ধরনের সুস্বাদু ‘শুরবা’ বা ঝোলও বিক্রয় ও প্রদর্শিত হয়।
স্বদেশের সুপরিচিত ভাবধারা ও রীতি অনুযায়ী ফ্রান্সের মুসলমানরা রমজানকে পালন করতে চেষ্টা করেন। তাই ইফতারের ভোজে তৈরিকৃত হরেক রকমের ইফতার চোখে পড়ে। নিজ দেশের মতো করে রমজানের ব্যয়ভার বহনে পরিবারগুলোতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে মাতৃভূমির বিরাজমান রোজার পরিবেশের অনুপস্থিতির বিষয়টি এসব পরিবার নির্দ্বিধায় স্বীকার করছে।
রোজার পরিবেশ
রমজানে এখানে রোজার পরিবেশ বিদ্যমান থাকলেও দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম অধিবাসীরা এখানে আজানের আওয়াজ শুনতে পায় না। আর ফ্রান্সে ব্যয় প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়; তবে এটি বিভিন্ন উপলক্ষে তৈরিকৃত সামগ্রী দিয়ে ইফতারের টেবিল সৌন্দর্যম-িত করতে বাধা হয় না। তাছাড়া এ সুন্দর উপস্থাপনে বিশেষ গুণ ও অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়।
রাজনীতি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষাধারী সাহাম নামের এক মহিলা বলেন, ‘এ মাসে আমাদের জীবনের দৈনন্দিন বিষয়ে সৃষ্ট কর্তব্য পালন অব্যাহত থাকাকালীন রোজার প্রথম দিকের দিনগুলো খুবই কঠিনভাবে পার হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোজায় দিনের বেলার সময় এখন বেশ লম্বা। তাছাড়া দৈনন্দিন কাজের ক্লান্তি তো আছেই। তবে তিনি রোজায় শারীরিক ক্লান্তি অনুভব করেন না।’
সাহাম বলেন, ‘আমি সৌভাগ্যবতী যে, আমি পরিবারের সঙ্গে ইফতার করছি এবং আত্মিক খোরাক ফিরিয়ে আনতে এ মাসকে কাজে লাগাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, মহিমান্বিত এ মাসটি আমাদের থেকে নেওয়ার তুলনায় অধিক পরিমাণে দিয়ে যায়।’
রমজানে মসজিদগুলোর চিত্র
ফ্রান্স মুসলিম ধর্মীয় পরিষদের সহকারী প্রধান ও ফ্রান্স মুসলিম সোসাইটির প্রধান আনোয়ার ইকবিবিশ ফ্রান্স ২৪ চ্যানেলে এক বিবৃতিতে বলেন, রমজানে ফ্রান্সের মসজিদগুলো মৌলিক দুটি দায়িত্ব পালন করে। একটি সামাজিক, অন্যটি আধ্যাত্মিক। তিনি বলেন, এ উপলক্ষে সমাজের সব স্তর ও বয়সের মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সাক্ষাতের সুযোগ তৈরি হয়। এমনকি উপস্থিতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য আকারে ছাড়িয়ে যায়। এছাড়াও তারাবি আদায়ের নিমিত্তে মুসল্লিরা আগ্রহভরে আগমন করে। তিনি বলেন, এ ধরনের পরিবেশ মুসল্লিদের একই পরিবারে সম্পৃক্ত হওয়ার অনুভূতির বিষয়টি জাগ্রত করে এবং পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করে। একেকটি মসজিদ যেন সামাজিক ঐকতানের কেন্দ্র। পবিত্র রমজানে এসব মসজিদ কর্তৃপক্ষ এবং মানবদরদি ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ব স্থাপনকারী প্রত্যেকেই এ মাসে অসহায়, দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, রোজা উপলক্ষে বেশ কিছু মসজিদে ইফতারির আয়োজন করা হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোজাদার এতে একত্রে মিলিত হন। মসজিদে ইফতারের আয়োজনের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা হয়। চাই সেটি সাধারণ মুসলমানদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে হোক, যেমনটি তারা তৈরিকৃত ইফতারি বিতরণে করে থাকেন। অথবা কিছু দানশীল ব্যক্তির আর্থিক অনুদান প্রদানের মাধ্যমে হোক। আর মসজিদগুলোও এসবে অংশগ্রহণে কল্যাণ ফান্ড থেকে ব্যয় করে থাকে। মসজিদগুলো জাকাতের অর্থ গ্রহণ ও জমা করার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করে। এমনকি এসব মসজিদ ঈদুল ফিতরে অভাবগ্রস্তদের সংখ্যা নির্ধারণপূর্বক জাকাতের অর্থ বণ্টনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মুহূর্তে সাহায্য প্রার্থীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
রমজানে মুসলিম ধর্মীয় পরিষদের ভূমিকা
আনোয়ার বলেন, ফ্রান্স মুসলিম পরিষদ ও তাদের সহযোগী সংগঠন সাধারণ মুসল্লিদের ও প্রবাসী মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান এবং তাদের কল্যাণী কাজে উদ্বুদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যার একটি হলো, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল হয়ে মাসের শুরু ও শেষের তারিখ নির্ধারণের বিষয়। সাধারণ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দল, বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তি, মসজিদ এবং সাংস্কৃতিক ও সেবা সংঘের প্রতিনিধি দলের আয়োজনে ‘উন্মুক্ত ইফতার’ এর আয়োজনের বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। এ অভিনব আয়োজন ইসলামের পঞ্চ খুঁটির একটি ‘রোজা’র ক্রিয়ার ব্যাপারে অবগতির বিষয়কে একটি ‘ধর্মীয় প্রকাশ’ হিসেবে উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের তৈরি খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ তো থাকছেই। মূলত এসব কিছুই ইফতারে আনন্দ প্রকাশ ও একটি সুন্দর আনুষ্ঠানিকতার রূপ দান করে।
লেখক : অধ্যয়নরত, উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মক্কা মুকাররমা