আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৪-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

রমজান এলেই মূল্যবৃদ্ধি, প্রয়োজন সরকারের কঠোর নজরদারি

এমএ মাসুম
| সম্পাদকীয়

খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রোজা সামনে রেখে আড়তদাররা পণ্য মজুত করায় কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে এবং এ কারণে দাম বাড়ছে। এক্ষেত্রে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের

কোনো কারণে দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে তা আর হ্রাস পাওয়ার কোনো সংস্কৃতি আমাদের দেশে আছে বলে মনে পড়ে না। আর রমজান মাস এলে তো কোনো কথাই নেই। রমজান এলে নানা অজুহাতে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর যে নীতি বহু বছর ধরে এ দেশে রয়েছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, রমজার শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই একের পর এক বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। রমজানকে অসাধুচক্র সময়ের সুযোগ হিসেবে ধরে নিয়েছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্মীয় আচার বা উৎসবকে কেন্দ্র করে পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বরং কমানো হয়। শুধু বাংলাদেশেই এর ব্যত্রিক্রম। মুখে ধর্মের বুলি আউড়িয়ে অধর্মের কাজ করতে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর মোটেও অসুবিধা হয় না।
এটা সুবিদিত যে, কয়েকটি মাত্র ব্যবসায়ী গ্রুপ ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও তারা দাম কমায় না। বস্তুত দেশে ভোগ্যপণ্যের প্রতিযোগিতার বাজার সৃষ্টি করা যায়নি। ভোক্তারা কম দামে পণ্য পাবে তখনই, যখন বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা কমিশনের তৎপরতা যথেষ্ট নয়। এ কমিশনের তৎপরতা বাড়ানো উচিত বলে মনে করি আমরা।
রমজানে নিত্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারকে নড়েচড়ে বসতে হবে। জোরদার করতে হবে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রমজানের আগে-পরে নিত্যপণ্যের দাম যাতে সহনীয় থাকে, সেজন্য বাজারে অধিদপ্তরের একাধিক টিম কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে বাজার স্বাভাবিক হওয়ার কোনো প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমলেও এর সুবিধা পাচ্ছেন না ভোক্তারা। উল্টো একের পর এক দাম বাড়িয়ে চলেছে একশ্রেণির অসাধুচক্র। বিশেষ করে রমজান এলেই নানা অজুহাতে কৃত্রিমভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় চক্রটি। এবারও বিরাজ করছে একই চিত্র। যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে ডলারের উচ্চমূল্য, আমদানিকৃত পণ্য খালাসে বিলম্ব, সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা প্রতিবন্ধকতাসহ রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। এতেই নাভিশ্বাস উঠেছে ভোক্তাদের। আসলে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতা। ভোক্তার সুবিধা-অসুবিধার কথা তারা কখনও ভাবে না, সুযোগ পেলেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকে।
বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে। তাই দেশের বাজারে পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু পবিত্র শবেবরাত ও রোজার বাড়তি চাহিদাকে ঘিরে খুচরা বাজারে চিনির দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে চিনি কিনতে মানুষকে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্যমূল্যের তালিকা অনুযায়ী এক মাস আগে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ছিল। এখন যা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ২৩ এপ্রিল বৈশ্বিক পণ্যবাজার নিয়ে একটি পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববাজারে প্রতি টন চিনির দাম ছিল ২৯০ মার্কিন ডলার, যা মার্চে কমে ২৮০ ডলারে নামে। বাংলাদেশি মুদ্রায় কেজিপ্রতি দর দাঁড়ায় প্রায় ২৪ টাকা। অবশ্য এর সঙ্গে আমদানি খরচ, বিভিন্ন ধরনের কর, অভ্যন্তরীণ পরিবহন খরচ ও বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের লাভ যুক্ত করে দেশে চিনির দাম নির্ধারিত হয়। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববাজারে চিনির দরে তেমন কোনো ওঠানামা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৭ সালে চিনির গড় দাম টনপ্রতি ৩৫০ ডলার ছিল। মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। পৃথিবীর কোনো দেশে ধর্মীয় উৎসবে পণ্যের দাম বাড়ায় না। শুধু বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। এখানে সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও দোষ আছে। তারা লাভ করুক; কিন্তু এত লাভ করলে গ্রাহক কোথায় যাবে?
ব্যবসায়ীর ব্যবসা করা যেমন অধিকার, তেমনই ভোক্তাদের সীমার মধ্যে কেনাকাটা করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সব পক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এভাবে একচেটিয়া মুনাফা করলে ভোক্তার কষ্ট হয়। কারা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মুনাফা করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদেরও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। পণ্য সরবরাহে যাতায়াত ব্যবস্থা নিñিদ্র হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও ডালের দর বেড়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই ব্যাপক চড়া সবজি ও মাছের দাম। সব মিলিয়ে ভোক্তারা স্বস্তিতে নেই রোজার বাজারে। দেশে এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। কিছুদিন আগেও পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দর ২৫ টাকার মধ্যে ছিল। এতে কৃষকরা দাম পাচ্ছিলেন না বলে অভিযোগ ছিল। এখন দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা, হাইব্রিড পেঁয়াজ ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে পেঁয়াজের দর কেজিতে ১০ টাকার মতো বাড়তি। চীনা আদা ও রসুনের দরও কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১২০ টাকা দরে। কেজিপ্রতি চীনা আদা ১২০ থেকে ১৩০ টাকা ও দেশি আদা ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা।
রমজান আসার আগেই রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নিত্যপণ্যের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে চলে যায়। বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে ডাল, ছোলা, চিনি ও পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে ডালের দাম প্রায় ৪৫ শতাংশ, ছোলার দাম প্রায় ১৪ শতাংশ, চিনির দাম ৪ শতাংশ ও পেঁয়াজের দাম ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। রোজার অনুষঙ্গ এ চার পণ্যের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে আড়তদাররা আন্তর্জাতিক বাজারকে দায়ী করছেন।
তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রোজা সামনে রেখে আড়তদাররা পণ্যগুলো মজুত করায় কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে এবং এ কারণে দাম বাড়ছে। এক্ষেত্রে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দাবি বাজার বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ ভোক্তাদের। রোজায় কাঁচাবাজারে হঠাৎ করেই বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম। তবে সবজির দাম যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে গরুর মাংসের দাম।
রাজধানীতে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম বাড়ল ১৫০ টাকা। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন নির্ধারণ করে বাড়িয়েছে ৭৫ টাকা। আর নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন আরও ৭৫ টাকা। সব মিলিয়ে এ রমজানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি! যা গরুর মাংসের দামের ক্ষেত্রে এক নতুন মাইলফলকই বলা যায়! কারণ এ দাম শোনার পর অনেককেই এ প্রিয় খাবার ছাড়ার কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালের রোজার আগে এক কেজি গরুর মাংস ছিল ২৫০ টাকা। পরে মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে সিটি করপোরেশন দাম বাড়িয়ে করে ২৭৫ টাকা। ২০১৪ সালের রমজানে ২৮০ টাকা, ২০১৫ সালে ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। সীমান্ত দিয়ে গরু আসছে না বলে একই বছরে বাড়িয়ে করা হয় ৩৭০ টাকায়। পরে ২০১৭ সালের রমজান মাসে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয় ৪২০ টাকা। একই অজুহাতে ২০১৭ আবারও বাড়িয়ে করা হয় ৪৪০ টাকা, সবশেষ ২০১৮ সালের রমজানে দাম ৫০০ টাকা করা হয়। তবে এ বছর রোজার আগে থেকেই গরুর মাংসের বর্তমান দাম ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। রোজা শুরু হওয়ার আগেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মাংস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে এ দাম নির্ধারণ করে। তাদের এ দাম নির্ধারণকে কাজে লাগান ঢাকাসহ সারা দেশের মাংস বিক্রেতারা। বৈঠকের পর তারা মাংসের দাম বাড়িয়ে দেন।
খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রোজা সামনে রেখে আড়তদাররা পণ্য মজুত করায় কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে এবং এ কারণে দাম বাড়ছে। এক্ষেত্রে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দাবি বাজার বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ ভোক্তাদের। একশ্রেণির ক্রেতা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। তারা সম্পদশালী মানুষ, সেটা বৈধ-অবৈধ যে উপায়েই অর্জিত হোক। দরকষাকষি না করলে বিক্রেতারা দাম বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পান। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। সরকারের উচিত হবে, রমজানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যাতে অতিরিক্ত আর্থিক চাপের সম্মুখীন না হন, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রমজানের আগে বা রমজানের সময় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো কাম্য নয়। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা করতে পণ্যের দাম বাড়ায়। দেশে যে পরিমাণে পণ্য আছে তাতে পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়। আবার কিছু কিছু পণ্যের দাম রমজানের এক মাস আগ থেকেই বাড়ানো হয়। এ কারণে সরকারের মনিটরিং সংস্থাগুলোর উচিত কঠোরভাবে মনিটরিং করে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা। হ

এমএ মাসুম
অর্থনীতি বিশ্লেষক