আজকের পত্রিকাআপনি দেখছেন ১৪-০৫-২০১৯ তারিখে পত্রিকা

উত্তরখানে তিন লাশের সঙ্গে রহস্যজনক চিরকুট

নিজস্ব প্রতিবেদক
| প্রথম পাতা

রাজধানীর উত্তরখানের একটি ভাড়া বাসা থেকে রোববার একই পরিবারের তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ছবিতে মা জাহানারা বেগম, বাবা ইকবাল হোসেন, ছেলে কাজী মুহিব হাসান ও মেয়ে তাসপিয়া সুলতানা -- সংগৃহীত

রাজধানীর উত্তরখানের মৈনারটেকের বাসা থেকে মা, ছেলে ও মেয়ের লাশের সঙ্গে দুইটি রহস্যজনক চিরকুট উদ্ধার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে একটি চিরকুট নিহত মা জাহানারা বেগম মুক্তার লেখা অপরটি ছেলে কাজী মুহিব হাসান রশ্মির লেখা। 

নিহত মা ও প্রতিবন্ধী মেয়ে আফিয়া সুলতানা মিমের পাশ থেকে একটি কাঁচের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। বোতলে ‘বিষ’ জাতীয় কোনো পদার্থ ছিল কিনা- তা পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে উদ্ধার করা চিরকুট দুটির 

হাতের লেখা মিলিয়ে দেখছে পুলিশ। একটি পাতার দুই পৃষ্ঠায় মুহিব ও তার মায়ের নামে চিরকুট লেখা রয়েছে। তবে এ দুইটি চিরকুটে হাতের লেখা একই রকম। মুহিবের মায়ের লেখা চিরকুটে বলা হয়েছে, ‘আমাদের মৃত্যুর জন্য আমাদের ভাগ্য এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজনের অবহেলা দায়ী। আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের সম্পত্তি গরিব মানুষকে দান করা হোক। ইতি-জাহানারা বেগম মুক্তা।’ পুলিশ মুহিবের ফেইসবুকের আইডি থেকে বেশ কয়েকটি লেখার স্ক্রিনশট নিয়েছে। এদের মধ্যে একটি ঘোষণায় বলা হয়েছে, এই সমাজে শিক্ষার দাম আছে, টাকা পয়সার দাম আছে, ভালো মানুষের দাম নাই। বিদায় সমাজ, তোমার কাছে আর আসব না।’
রোববার রাতে লাশ উদ্ধারের পর সোমবার রাত পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। পুলিশের কাছে নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা জানিয়েছেন যে, লাশ দাফন করে তারা মামলা দায়ের করবেন। পুলিশের তৈরি করা লাশের সুরতহালের বর্ণনা দিয়ে উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজুর রহমান রিয়েল বলেন, তিন রুমের বাসার একটি কক্ষের বিছানায় মা ও মেয়ের লাশ পড়ে ছিল। দুইজনের শরীরের পেটে ও গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এর পাশাপাশি দুইজনের গলায় কালো দাগও রয়েছে। দুই লাশের মাঝখানের একটি কাঁচের বোতল পড়েছিল। বোতলের ভেতর কোনো তরল পদার্থ ছিল না। মেঝেতে ছেলের লাশ পড়ে ছিল। নিহত কাজী মুহিব হাসান রশ্মির গলায় ধারালো গভীর জখমের চিহ্ন রয়েছে। ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে গলার সামনের দিকে এক পাশ থেকে অপর পাশ পর্যন্ত কাটা দাগ রয়েছে। মেঝের বিভিন্ন স্থানে রক্তের দাগ রয়েছে। রক্ত শুকিয়ে গেছে। মেঝেতে একটি বঁটি পড়েছিল। বঁটিতে রক্তের দাগও রয়েছে। 
মৈনারটেকে একতলা বাড়িটির আশপাশের বাসিন্দারা জানান, ২ মে ওই বাড়িতে পরিবারটি ওঠার পর কাউকে বাড়ির বাইরে বের হতে দেখেননি। এই গরমেও বাড়ির জানালাগুলোও বন্ধ থাকত। এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক হয়। এক এলাকাবাসী বলেন, আমরা তো প্রথমে ধারণা করেছিলাম যে জঙ্গি গ্রুপের কোনো সদস্য ওই বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠেছেন। কিন্তু লাশ উদ্ধারের পর বিষয়টি নিয়ে অন্য ধরনের ধারণা তৈরি হয়।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজুর রহমান রিয়েল বলেন, মুহিব সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে চাকরি খুঁজছিলেন। সম্প্রতি তিনি ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নেন। মুহিবের ছোট বোনটি ছিল প্রতিবন্ধী। মূলত এই প্রতিবন্ধী বোনটিকে নিয়ে তাদের পরিবারে অশান্তি ছিল। মুহিবের বাবা ইকবাল হোসেন বছর খানেক আগে মারা যান। তিনি কুমিল্লায় পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার পিতার অবসরকালীন পেনশেন উত্তোলন নিয়ে মুহিব মানসিক পীড়নের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। মুহিবের বাবার মৃত্যুর পর তাদের পরিবারটি ঢাকায় অন্তত ছয়বার বাসা বদল করেছেন। তার প্রতিবন্ধী বোনটি বাসায় চিৎকার করতেন। মাঝে মধ্যে উলঙ্গ অবস্থায় বাড়ির বাইরে দৌড় দিতেন। এ কারণে কোনো বাসায় তারা ২ থেকে ৩ মাসের বেশি ভাড়া থাকতে পারতেন না। মুহিব তার চাকরি নিয়ে মানসিক অশান্তিতে ছিলেন। সব মিলিয়ে তার ফেইসবুকের টাইম লাইনে বৃহস্পতিবার একটি ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে এসব কারণ তাদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করেছে কিনা- তা তদন্ত করা হচ্ছে। 
তিনি আরও বলেন, লাশ উদ্ধারের সময় আমরা বাড়ির দরজা ভেঙে ফেলেছিলাম। তবে ৩ থেকে ৪ দিন আগের লাশ হওয়ায় পঁচে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে। তিনটি লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে হত্যার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য জানা যাবে।
উত্তরখান থানার ওসি হেলাল উদ্দিন বলেন, মা ও ছেলের লেখা চিরকুটে একই ধরনের হাতের লেখা। বিষয়টি আত্মহত্যা নাকি হত্যা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নিহতদের আত্মীয়-স্বজনরা বলেছে, লাশ দাফনের পর তারা থানায় এসে মামলা করবেন। যদি তারা এ বিষয়ে মামলা না করে তাহলে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হবে।