মাছ চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছেন রাজশাহীর চাষিরা। সবজির ক্ষেত্রেও তাই। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিনই প্রচুর মাছ এবং সবজি ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। রাজশাহীর আড়ত থেকে মাছ এবং সবজি নিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঢাকায় যান। কিন্তু রাজশাহী থেকে ঢাকায় যেতে ট্রাকচালককে অন্তত ১৪টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। কয়েকটি স্থানে শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা নেওয়া হলেও বেশিরভাগ স্থানেই টাকা আদায় করে পুলিশ। রাজশাহীর চাষি, ব্যবসায়ী এবং ট্রাক চালকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানিয়েছেন, মহাসড়কে পুলিশ থামালে বেশিরভাগ চালকই কোনো কথা না বলে টাকা বের করে দেন। পুলিশ টাকা নিয়ে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু কেউ টাকা কম দিলেই বাধে বিপত্তি। গাড়ি সাইড করিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ঝামেলা এড়াতে চালকরা চাহিদামতো টাকা দিয়ে দেন। স্পটে স্পটে কমপক্ষে ৫০ থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় তাদের। আবার মামলার ভয় দেখিয়ে কখনও কখনও এক স্থানেই আদায় করা হয় ৫০০ টাকা। এ টাকা ভাড়া হিসেবে ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই নেন চালকরা।
প্রতিদিন ভোরের সূর্য ওঠার আগেই রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ আমচত্বর ও খড়খড়ি এলাকার আড়তে আসতে থাকে মাছ। বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে মাছ কিনে আশপাশের এলাকায় থাকা তাদের হাউজে রাখেন। তারপর বিশেষ কায়দায় ট্রাকে রাখা পানিতে জীবন্ত রেখে মাছ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। প্রতিদিন বিকাল ৩টার দিকে ট্রাকগুলো ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। একইভাবে একই সময় রাজশাহীর বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে সবজিভর্তি ট্রাক। পরের দিন গভীর রাতে অথবা ভোরে ট্রাকগুলো ঢাকার মোকামে পৌঁছায়। খুব সকালেই সেখানে মাছ আর সবজি বিক্রি করতে হয়।
খড়খড়ি মাছের আড়তে গিয়ে ব্যবসায়ী ও ট্রাকচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর পশ্চিমপ্রান্ত কাশিয়াডাঙ্গা মোড় থেকেই চাঁদা আদায় শুরু হয়। কিছু দূর না আসতেই আমচত্বর এলাকায় আবার চাঁদা দিতে হয়। খড়খড়ি আড়ত থেকে গাড়ি ছেড়ে পুঠিয়া উপজেলায় প্রবেশের আগেই আমচত্বর-বেলপুকুর সড়কের যে কোনো ফাঁকা স্থানে চাঁদা দিতে হয়। সেখানে পুলিশ দাঁড়িয়েই থাকে। এরপর পুঠিয়া উপজেলা সদর, নাটোরের তেবাড়িয়া মোড়, কাছিকাটা, চৌরাস্তা মোড় ও বনপাড়ায় চাঁদা দিতে হয়। চলনবিলের ভেতর ফাঁকা স্থানে হাইওয়ে পুলিশকেও একবার চাঁদা দিতে হয়। যাত্রাপথে আবার সিরাজগঞ্জে যমুনা সেতুর পশ্চিমে, টাঙ্গাইল সদর, এলেঙ্গা, মির্জাপুর, চন্দ্রা ও আশুলিয়ায় চাঁদা দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি চাঁদা দেওয়া লাগে নাটোরের ভেতর।
গেল বছরের ১৬ মে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের আগ্রান সুতিরপাড় এলাকায় চাহিদামতো চাঁদা না দেওয়ায় রশি কেটে পিকআপে থাকা পৌনে ৩ লাখ টাকার ডিম রাস্তায় ফেলে দেয় হাইওয়ে থানা পুলিশ। এতে পিকআপে থাকা ৩৫ হাজার ১০০ ডিমের প্রায় সবই ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। এ ঘটনাটি সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনাটি পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়। সত্যতা পাওয়ায় বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলীম হোসেন সিকদারসহ সাত পুলিশকে প্রত্যাহার করা হয়। আর ভুক্তভোগী ডিম ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জের বিপ্লব কুমার সাহা ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন।
রাজশাহীর খড়খড়ি আড়ত থেকে প্রায় ৭ বছর ধরে ঢাকায় মাছ নিয়ে যান পবা উপজেলার পোড়াপুকুর গ্রামের পিকআপচালক আলমগীর হোসেন। ঢাকা যেতে সমস্যা কীÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো সমস্যা নাই। শুধু সমস্যা পুলিশ। ওদের শুধু টাকা চাই, টাকা চাই। টাকা না দিলেই বিপদ। সানি বলেন, ট্রাক এবং পিকআপে রাজশাহী থেকে প্রচুর সবজি এবং মাছ ঢাকায় যায়। পুলিশের এ ট্রাক এবং পিকআপগুলো মুখস্ত। দেখলেই থামানোর সংকেত দেয়। রাজশাহীর মাছ আর সবজিভর্তি ট্রাকগুলো পুলিশের টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
রাজশাহী থেকে ট্রাকে সবজি নিয়ে যান ট্রাকচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের অন্তত ১৪টি স্থানে পুলিশ ও শ্রমিক সংগঠনের লোকজনকে টাকা দিতে হয়। এ পথে চলাচলের জন্য এখন এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা ভাড়া ধরেন বেশি।