স্মৃতির মানসপটে যুক্তরাজ্য সফর

বিদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই হয়ে থাকে। তবে কলেজের প্রতিনিধি, তথা দেশের প্রতিনিধি হিসেবে এত অল্প বয়সে বিদেশ ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়তো সবার হয় না। যেমনটা হয়েছে ক্যাডেট কলেজগুলোর সম্মিলিত যুক্তরাজ্যগামী দলের। ১২ ক্যাডেট কলেজ থেকে নির্বাচিত ১২ ক্যাডেটের একজন হতে পেরে আমি নিজেকে সত্যিই সৌভাগ্যবান মনে করি। যুক্তরাজ্যের মতো নয়নাভিরাম, ঐতিহ্যবাহী, প্রাচীন সভ্যতার ধারক এবং উন্নত একটি দেশ সফর করার অভিজ্ঞতার পুরোটাই ছিল রোমাঞ্চ ও আনন্দের ছোঁয়ায় ভরপুর।
১৫ জনের সংযুক্ত দলে একেএম আজিজুল হক স্যার, আইরিন পারভীন ম্যাডাম এবং দলনেতা অ্যাডজুটেন্ট মেজর হিমেল মিঞা স্যারকে সঙ্গে পেয়ে আমাদের ১০ দিনের সফরটি হয়েছে আরও আনন্দঘন। যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে আমরা রওয়ানা হলাম ২০ জুন, ২০১৮। কাতার এয়ারওয়েজে ১৮ ঘণ্টার মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ শেষে আমরা লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছলাম সেখানকার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় এবং সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন স্টো স্কুলের কম্বাইন্ড ক্যাডেট ফোর্স (সিসিএফ) শাখার শিক্ষক মেজর জেন এবং স্টাফ সার্জেন্ট স্ফ্রুল্স। ‘স্টো’ স্কুলে পৌঁছে মিনিভ্যান থেকে নামার পর যেমনটা মুগ্ধ হলাম স্কুলের অসাধারণ ক্যাম্পাস দেখে, তেমনটাই শিহরিত হলাম সেখানকার গ্রীষ্মকালীন বৈকালিক আবহাওয়ায়। পরিচিত হলাম সমবয়সি কয়েকজন ‘স্টোইকদের’ (স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পরিচিতিমূলক নাম) সঙ্গে যারা আমাদের নিয়ে গেল আমাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে। সেখানে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র রেখে আমরা ডাইনিং রুমে গেলাম যেখানে আমাদের জন্য সান্ধ্যকালীন নাশতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাত ৯টায় সূর্য ডুবতেই আমরা ফিরে এলাম আমাদের কক্ষে। এসে পরিচ্ছন্ন হয়ে, জিনিসিপত্র গুছিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে বিদায় জানালাম সেই দিনকে। 
পরদিন সকাল থেকে শুরু হয় পরিচিতি পর্ব। ৭০০ একরজুড়ে বিস্তৃত ‘স্টো’ স্কুলের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সম্বন্ধে জেনে বেশ প্রীত হলাম। বিশেষ করে স্কুলের সৌকর্যম-িত ভাস্কর্যগুলো এবং সুরম্য অট্টালিকার ঐতিহ্যবাহী কাঠামো দেখে। বিকালবেলা নেমে পড়লাম তাদের অপূর্ব সুন্দর কাউন্টি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে কাটল বিকালটি। ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা, হেডমাস্টারের সঙ্গে কথোপকথন, সান্ধ্যকালীন বারবিকিউ পার্টি এবং কিছু স্যুভেনির আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলো দিনটি।
২২ তারিখ সকালে নাশতা করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম লন্ডনের উদ্দেশে। ঘুরে দেখলাম ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি এবং আশ্চর্য হলাম তাদের পরিচ্ছন্নতাবোধ দেখে। বাকিংহাম প্যালেসের গার্ড মাউন্ট প্যারেড, হাউজ অব লর্ডস, লন্ডন আই, ওয়েলিংটন ব্যারেকস, ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবেসহ ঘুরে দেখলাম লন্ডন শহরের নানা আকর্ষণীয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। ছোট একটি ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ ঘটে গেল অভাবিতভাবে। এ দিনটি ছিল বাকিংহাম প্যালেসের গার্ড পরিবর্তনের দিন, যা প্রতি দেড় মাস পরপর অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ পরিবর্তনের ইতিহাসেও প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ১৪০ পদক্ষেপে প্যারেডের পরিবর্তে ১৮০ পদক্ষেপে প্যারেড হলো প্রায় দৌড়ের মতো করে। সারা দিনের ঘোরাফেরা শেষে যখন ফিরে এলাম স্কুলের ক্যাম্পাসে, তখন সান্ধ্য অবসরে পরিচিত হলাম স্কুলে অধ্যয়নরত বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে কেটে গেল সন্ধ্যা এবং নতুন বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল আমাদের মাঝে।
২৩ তারিখ সকালে রীতিমতো নাশতা সেরেই আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার যাত্রা করলাম অক্সফোর্ড শহরের উদ্দেশে। সফরের সময়জুড়েই আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন মেজর জেন এবং সার্জেন্ট স্ফ্রুলস। তাদের রসিকতা এবং বন্ধুসুলভ আচরণে আমাদের পুরো সফরটাই কেটেছে আনন্দ-উল্লাসে। স্থানীয় বাসে ভ্রমণ করে যখন আমরা শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখতে মগ্ন, তখনই হঠাৎ জানতে পারি যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রাক্তন ক্যাডেটদের একটি দল আমাদের জন্য একটি প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁয় বুফে লাঞ্চের আয়োজন করেছে। একথা জানার পর আমাদের উল্লাস আর দেখে কে! রেস্তোরাঁয় পৌঁছতেই আমাদের সানন্দে অভ্যর্থনা জানালেন প্রাক্তন ক্যাডেটরা। খাওয়া-দাওয়া, গল্প-আড্ডা শেষে প্রাক্তন ক্যাডেটদের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু স্যুভিনির দেওয়া হলো। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম, রওনা হলাম কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। অক্সফোর্ডের নামি-দামি দোকান থেকে কিনলাম পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের জন্য কিছু উপহার এবং নিজের জন্যও কিছু জিনিস। সন্ধ্যায় স্কুলে পৌঁছতেই জানলাম সেদিন স্টোইকদের চলছে সাপ্তাহিক বিনোদন সন্ধ্যা; যাকে তারা বলে ‘স্টোবাক্স’। হাতমুখ ধুয়ে আমরা কেউ কেউ যোগ দিলাম ‘স্টোবাক্সে’; কেউ কেউ সময় কাটালাম হাউজের কমনরুমে। বিনোদনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে এলো সে দিনটি। 
২৪ তারিখ ছিল স্কুল ক্যাম্পাসে আমাদের শেষ দিন। সেদিন আমাদের প্রথম খাবারের আয়োজন ছিল ‘ব্রাঞ্চ’ যা কিনা ছিল ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চের মাঝামাঝি সময়ে। জিনিসপত্র গুছিয়ে যখন আমরা সিসিএফ আর্মি সেকশন সামার ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, যা ছিল আমাদের সফরের মূল ইভেন্ট তখন বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের ডিফেন্স অ্যাটাসে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং কিছু বার্তা আদান-প্রদান করেন। দুই ঘণ্টার যাত্রা শেষে ক্যাম্পে পৌঁছতেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পের আবাসনে। আবাসনে সুস্থির হতে না হতেই আমাদের বাংলাদেশ ক্যাডেট দলকে নিয়ে যাওয়া হয় রাইফেল প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে আমাদের দিনটি সমাপ্ত হয়।
২৫ তারিখ, ট্রেনিংয়ের প্রথম দিন ছিল সবচেয়ে ঘটনাবহুল। কেননা, সেদিনকার কার্যক্রমই ছিল পুরোটা রোমাঞ্চকর অভিযান। টাওয়ার ক্লাইম্বিং, মাউন্টেন বাইকিং, অ্যারো ট্যাগ, লং বো এবং ওয়াটার অ্যাকটিভিটিস ছিল সেদিনকার আকর্ষণীয় দিক। বিশাল লেকের মাঝে কায়াকিং, র‌্যাফটিং ইত্যাদি ছিল সবচেয়ে আনন্দদায়ক। দিনব্যাপী এ কর্মকা- খুবই সুবিন্যস্ত ছিল। সমতল, পাহাড়, অরণ্য আর পানির মাঝে বিন্যস্ত এসব কর্মকা-ে দিনটি কোনদিক দিয়ে শেষ হয়েছে তাও বুঝতে পারিনি। রোমাঞ্চ আরও বেড়ে যায় যখন আইরিন ম্যাডাম, আজিজ স্যার এবং হিমেল স্যারও আমাদের সঙ্গে নানা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন।
২৬ এবং ২৭ তারিখে ছিল নানা শুটিং কার্যক্রম, তীর নিক্ষেপ, শটগান, প্রতিবন্ধক দৌড়, পেইন্টবল শুটিং, লেসার কোয়েস্ট, প্রাথমিক চিকিৎসা, রুম ক্লিয়ারেন্স, ট্র্যাকিংসহ আরও নানারকম সামরিক প্রশিক্ষণ। কার্যক্রমগুলোতে বাংলাদেশের ক্যাডেটদের অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ এবং প্রশংসনীয়। প্রশিক্ষকরা বিস্মিত হয়েছেন আমাদের দ্রুত শেখার এবং আয়ত্তে আনার ক্ষমতা দেখে। ট্রেনিং চলাকালীন সর্বদাই আমাদের কাঁধে ছিল ভারি ব্যাগ এবং রাইফেল। তবে রোমাঞ্চের উচ্ছ্বাসে সব কষ্টই যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। প্রশিক্ষণের সব কার্যক্রমই ঘন বন-জঙ্গলে হয়েছিল এবং সেদিন আমরা রাত্রিও যাপন করেছিলাম গহিন বনের গভীর আঁধারে। জঙ্গলে আমাদের সারা দিনের খাবারের উৎস ছিল রেশনের একটি বাক্স যাতে ছিল রান্না করা নানা সামগ্রী এবং অর্ধ-প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আর ছোট একটি ফিল্ড স্টোভ। ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে সে স্টোভ জ্বালিয়ে কোনোমতে প্যাকেটগুলো গরম করে খাওয়ার মাঝেও ছিল অসীম তৃপ্তি।
পরদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সব কার্যক্রমের মধ্যে ছিল অ্যাম্বুস, পেট্রোল অ্যান্ড রেইড এবং নানা বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ। অত্যন্ত আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে সেদিন শেষ হলো সিসিএফের রোমাঞ্চপূর্ণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
এতদিন ব্রিটিশদের সঙ্গে একই সঙ্গে থাকা, কার্যক্রমে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করা, অপরাপর দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আবহাওয়া, জীবিকা সম্পর্কে কথোপকথন ইত্যাদি গড়ে তুলেছিল আমাদের এবং ব্রিটিশদের মাঝে এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ক্যাম্প শেষে লন্ডনের উদ্দেশে ফেরার আগে তাদের বিদায় জানাতে গিয়ে সেটা বুঝলাম। যুক্তরাজ্যের মনোরম আবহাওয়া, স্টো স্কুলের ক্যাম্পাস এবং সেখানকার বন্ধুদের ছেড়ে চলে আসতে হবে ভেবেই আমাদের খারাপ লাগছিল। তবে সত্যিই বুঝলাম যে, এত সুন্দর অভিজ্ঞতার অংশীদার হতে পেরে আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। যুক্তরাজ্য সফরের প্রতিটি মুহূর্ত তুলে রেখেছি ক্যামেরার মেমোরিতে। হয়তো সেটি হারিয়ে যেতে পারে, তবে হৃদয়ের গভীরে আজীবন স্মরণ থাকবে এ সফরের কথা, সফরকারী দলের প্রতিটি হাসিমুখের কথা; বিশেষ করে আজিজ স্যারের রসিকতা, আইরিন ম্যাডামের স্নেহভরা যতœ এবং অবশ্যই হিমেল স্যারের দেওয়া প্রত্যেকটি আপ্যায়নের কথা। ক্যাডেটদের প্রত্যেকে ভিন্ন জেলার ভিন্ন কলেজের হলেও সর্বদা আমাদের মাঝে ছিল এক অতুলনীয় ভ্রাতৃত্বের ও ঐক্যের বন্ধন। খুব অল্প সময়েই আমরা বন্ধুত্বের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হয়েছি এবং দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি একটি দল হিসেবে। এ সফরের প্রতিটি মুহূর্ত এবং অভিজ্ঞতা মনে থাকবে আজীবন। হয়তো জীবনে চলার পথে ভ্রমণ হবে নানা দেশে, হবে নতুন অভিজ্ঞতা; তবে এ সফরের সমতুল্য কোনোটিই হবে না। স্মৃতির মানসপটে এ সফরটি হয়ে থাকবে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং অম্লান।  

ক্যাডেট ইফতেখার
ক্যাডেট নং-৩০৭৭
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ


আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ পেলেন ৯০ প্রাণী
পোলট্র্রির বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, সঠিকভাবে রোগবালাই নির্ণয়, চিকিৎসা এবং রোগ
বিস্তারিত
সবার উপরে বাবা-মা
যে-কোনো মানুষের গায়ে হাত তোলাই অপরাধ। আর সন্তান হয়ে বাবা-মায়ের
বিস্তারিত
ব্যবসার ধারণা : গড়তে চাইলে
নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে আপনাকে উদ্যোগী হতে হবে। আর উদ্যোক্তা
বিস্তারিত
৭৫ শতাংশ বৃত্তিতে আইটি ও
বিভিন্ন কারণে যারা আইটিতে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত তাদের
বিস্তারিত
লক্ষ্য যখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে ক্রমাগত উর্বরা জমির পরিমাণ কমছে। জনসংখ্যার এ
বিস্তারিত
পথ চলতে ও বাসে চলাচলের
তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তরুণ প্রজন্মই আগামীতে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব
বিস্তারিত