(গল্প)

ধৈর্যের ফল


ফারুক হোসেন


নীরব নিস্তব্ধ রাত। বাতাস বইছিল ঝিরি ঝিরি। আস্তে আসেস্ত মনে হয় ঝড়ে রূপ নেবে। ফ্লোরে ম্যাটে হাটু ভাজ করে বসেছিল খাদিজা ও তার দুই ছেলে সিরাজ ও মিরাজ। খাদিজা বার বার দেখছিলেন জানালার দিকে। জানালার দিকে মায়ের বার বার তাকানো ছেলেরা লক্ষ করেনি। মা আবার দেখছিলেন। ঝড়ের আকার ধীরে ধীরে বেড়ে চলছে। উদ্বিগ্ন মা। ওদের বাবা হাসান কাজ থেকে কেমন করে ফিরবে। ফিরতে কতটা দেরি হবে। নিরাপদে ফিরতে পারবে তো। খাদিজা অস্থির হয়ে উঠলেন। বাইরে ঝড়ের শব্দ একরকম উপভোগ করছিল সিরাজ ও মিরাজ। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ যেনো মেশিনের মতো শোনায়।

হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ শুনল খাদিজা। নিশ্চয়ই ওদের বাবা এসে গেছে। যাক, চিন্তা কেটে গেল। মা বললেন ওদেরকে, যাও তোমাদের বাবা এসেছেন।  দরজা খুলে বাবাকে  নিয়ে এসো। তোমাদের দেখলে বাবার ভালো লাগবে।

মিরাজ বলল, মা, বাবা কি আমাদের জন্য খাবার এনেছে? 
মা মৃদু স্বরে বললেন, এখন এটা জরুরী নয় বাবা। বাবাকে এখন এসব নিয়ে প্রশ্ন করোনা। আগে দেখো বাবা ঠিকমতো ফিরতে পেরেছেন কি না ?

ওরা দুজনেই ছুটে গেলো দরজার দিকে। খাদিজা চিন্তিত ও একটু এগিয়ে গেল দরজার দিকে একই সঙ্গে। ছেলেরাই তাকে বরণ করবে। খাদিজা দুরে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সেই দৃশ্য। দীঘস্বাস ফেলে অনুভব করল স্বস্তি।

হাসান ঘরে এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন বাটার পনির আর রুটি। রাতের খাবার। খাদিজার হাতে দিলেন খাবারের প্যাকেট। খাদিজা সবাইকে পরিবেশন করলেন। হাসান দৃষ্টি লম্বা করে দেখলেন, প্লেটটার রং ঝাপসে গেছে। আর এ প্লেটটি ব্যবহারযোগ্য নেই।

রাতের খাবার খেয়ে সিরাজ ও মিরাজ খুব খুশি। খাদিজা দেখছিলেন, ওদের মুখে রাজ্যের হাসি। ওদের খুশ দেখে খাদিজারও বুক ভরে গেল আনন্দে। মনের মধ্যে জেগে ওঠে অনেক স্বপ্ন। সিরাজ আর মিরাজ খেলনা পুতুলের মতো ছুটোছটি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। বাবা মা এবার একটু চুপ চুপ হয়ে বসলেন। যেনো সুযোগ পেলেন একান্তে কথা বলার।

হাসান বলছিলেন, এক বছর তো হয়ে গেল। চিন্তিত কন্ঠে বললেন, এখনও কোন একটা কাজ পাইনি। জমানো টাকা ভেঙে খাচ্ছি। পুরনো ফার্নিচার বিক্রয় করে দিলাম। আর কিছু হাতে নেই, সামনে ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। তার মধ্যে ছেলেদের মানুষ করা।

খাদিজা বললেন, আমাদের বিশ্বাস আছে। চেষ্টা আছে। ধৈর্য আছে। সুখ আনতে জীবনে যা যা প্রয়োজন সবই আমাদের আছে। 

বিশ্বাস কি আমাদের জন্য সুখ নিয়ে আসবে। হাসানের কন্ঠে হতাশার ছায়া।  আমাদের সন্তানেরা টুটা কাপড় পড়ে থাকছে। না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। এটা কেমন বিশ্বাস যা আমাদের জীবনকে কষ্টময় করে তুলেছে ? যা আমাদের জীবনে এনে দিয়েছে দারিদ্র। আমরা আগে কত সুখে ও ঝাঁকঝমকে দিন কাটিয়েছি। সেদিনের কথা ভুলতে পারিনা।

খাদিজা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, জীবন সুখে ও ঝাঁকঝমকে ছিল? যে পরিবারের নির্ভর করতো জুয়ার টাকায় সেটাকে তুমি সুখ বলছ। আমাদের জন্য জুয়া খেলা নিষিদ্ধ। আমরা জেনেও কেন তাকে ভালো বলছি। আমরা তখন যে খাবার খেয়েছি, কাপড় পরেছি তা আমাদের আগুনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের লাভ অন্যকে দরিদ্র ও উদোম বানিয়েছে। এটা নৈতিকভাবে খারাপ কাজ।

আমি জানি তুমিই হয়তো ঠিক, হাসান বললেন। এসব কারণেই তো আমি জুয়া খেলো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তাতে কি পেলাম। আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে, তুমি এ সংসার চালিয়ে নিচ্ছো। মহান আল্লার দোয়া আছে,তাই বেঁচে আছি । কিন্তু সত্যি বলতে কি, এখন দারিদ্র লজ্জার। এ লজ্জার টানাপোড়েন আর বইতে পারছি না। অন্যরা বড় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।

খাদিজা সান্তনা দিয়ে বললেন, তুমি বোঝনা কেনো, এ কষ্ট সাময়িক। আল্লাহ বলেছেন, সব কষ্টই  আনন্দের ফল নিয়ে আছে। সামনের দিনগুলো অনেক দীর্ঘ। ভবিষ্যত অন্তহীন। আমাদের অশা রাখতে হবে ভবিষ্যতের উপর। প্রস্তুত হতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। অতীতের জন্য আফসোস করোনা। বরং আল্লার কাছে শোকর করো, তার দয়া গ্রহণ করো। তিনি মানুষকে এ দয়া গ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন। সুখ তিনি তাদের জন্য রেখেছেন, যারা ধৈর্য্যশীল, পরিশ্রমী ও তার প্রতি বিশ্বাাসী। 

ঠিক খাদিজা, হাসান বললেন, আমি আশা ছাড়িনি। কিন্তু ভয়, পাপ চারপাশে ঘর ঘুর করছে। এ পাপ আমাকে কখন ঘিরে ধরে। তখন তো আমি সব হারাব। 

চিন্তা করোনা , এখনও আমাদের বিয়ের আংটি আছে। কাল চলো ওটা বিক্রি করি। কিছু টাকা পাব। কিছুদিন যাবে, এরমধ্যে আল্লাহ আমাদের দিকে ফিরে চাইবেন। তুমি চাকরি পাবে। আল্লাহর কাছে সেভাবে চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না।  নিশ্চয়ই দেখবে আমাদের দিন বদলে গেছে। 

লম্বা শ্বাস টেনে হাসান বললেন, যদি তুমি তাই মনে করো, আমিও মানছি। আমারও তাই বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের চেষ্টার পেছনে প্রয়োজনীয় সেই প্রজ্ঞা আছে কি?

খাদিজা বললেন, তুমি কি কুরআনের সেই বাণী জানোনা, তোমার রব তোমাকে পরীক্ষা করবেন, তুমি তাকে ভয় করো। ক্ষুধা, সম্পদের হানি এবং জীবন তিনিই রক্ষা করবেন। সুতুরাং ধৈর্যধারণকারীকে এ সুসংবাদ দাও। 

কিন্তু কখন এই ধৈর্য শেষ হবে। 

যখন তাঁর কাছে আমাদের পরীক্ষা সফলভাবে শেষ হবে। ধৈর্যের মাধ্যমে, চেষ্টার মাধ্যমে, উপার্জনের অবৈধ পথ পরিহারের মাধ্যমে, আমাদের পরীক্ষা সফল হবে। 

কথা বলতে বলতে অনেক রাত। দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল শেষে। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে হাসান ও খাদিজা প্রশান্তির ঘুম শেষ করল। ভোর দুজনেই উঠল নামাজের জন্য। নামাজ শেষে খাদিজা বসে গেল নাশতা বানাতে। হাসান বসে পড়ছিল কুরআনের সুরা। সিরাজ আর মিরাজ উঠে পড়ল ঘুম থেকে। মা তাদের সকালের চা দিলেন। মিরাজের  মর্জি বেশি। সে ব্রেড চাইল মায়ের কাছে। মুখ ভার করে বলল, তার বন্ধু সকালে ব্রেড ও বাটার খায় চায়ের সঙ্গে।

ওর কথায় মা কষ্ট পেলো। তবুও হাসল। নিজেকে খুব শীতল রাখল। চুমু খেলো ছোট ছেলের কপালে আদর করে। আল্লাহ চাইলে কাল থেকে হবে। তুমি যা চাও তাই হবে।
মিরাজ মায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো, বলল, মা আল্লাহ চাইলে বলো কেনো।

খাদিজা বললেন, আল্লাহই আমাদের সবকিছু দেন। আমাদের কাজ করার শক্তি সামর্থ দেন। তার ইচ্ছা ছাড়া এমনকি আমরা নিঃশ্বাসও ফেলতে পারিনা। 

তার মানে কি আল্লাহ আমাদের ব্রেড ও বাটার দেবে কাল। 
হ্যাঁ বাবা, আল্লাহ চাইলে তাই হবে। তিনিই দেবেন।

এদিকে মা ছেলের কথা শুনছিলেন, হাসান। তিনি খাদিজার বিশ্বাসের গভীরতা দেখে অবাক হলেন। খাদিজার বিশ্বাস দেখে হাসান নিজেও আশাবাদী ও আত্ববিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। তিনিও ছেলেদের সঙ্গে বিশ্বাস নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। কথা বললেন ভবিষ্যতের কথা নিয়ে। কিভাবে বাবা ভবিষ্যতে একটা ভালো কাজ পাবেন তা বললেন। তখন ওরা চাইলেই তিনি মিষ্টি ও ফল কিনতে পারবেন। 

এমন সময় দরজায় টোকা দিলো কেউ যেনো। এত সকালে আবার কে? হাসান নিজেই গিয়ে দরজা খুললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সবার কাছে ফিরে এলেন। তার মুখ উজ্জ¦ল ও হাসিভরা। 

খাদিজা তাকে দেখে বললেন, নিশ্চয়ই আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। 

আবেগের সুরে হাসান বললেন, হ্যাঁ তাই। ধৈর্যের পরে আমাদের দিকে আল্লাহ মুখ ফিরিয়ে চেয়েছেন। তুমি আমার সেই ধৈর্যকে অর্থবহ করেছ, বিশ্বাস ও চেষ্টা দিয়ে। 

কে এসেছিলেন, খাদিজা বললেন।
হাজী সাহেব।
তিনি নিজেই।
হ্যাঁ, তিনি তার ব্যবসার জন্য একজন ম্যানেজার খুঁজছেন। তিনি জানতে পেরেছেন আমার একটা কাজ দরকার ও আমার এ কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি আমাকে কাজের অফার দিলেন।

হাসান বললেন আল্লাহ চাহেতো আমাদের সুখের দিন আসছে। কিন্তু তুমিই আমাকে ধৈর্যের দ্বার দেখিয়েছে। 

হাসান স্ত্রী খাদিজার গায়ে হাত রেখে বললেন, একজন ভালো নারী হাজার পুরুষের চাইতে উত্তম।

(একটি নীতিকথার গল্প, মধ্যপ্রাচ্যের কাহিনী অবলম্বনে)


এনাম রাজুর তিনটি কবিতা
এনাম রাজুর তিনটি কবিতা এক যদি পূর্ণবার ঘর থেকে বের হয়ে দেখি
বিস্তারিত
ফখরুল হাসানের দুটি কবিতা
ফখরুল হাসানের দুটি কবিতা  জানালাহীন মাটির ঘর জগৎখ্যাত সার্চ লাইট দিয়ে খুঁজে
বিস্তারিত
একটি মানবিক আবেদন
    কবি জাহাঙ্গীর কবির গানের কলি দিয়েই বলি  “মানুষ মানুষের
বিস্তারিত
'তবু আমারে দেব না ভুলিতে'
'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব/তবু আমারে দেব না ভুলিতে'- লিখেছিলেন
বিস্তারিত
আমাদের চলচ্চিত্রে একজন জহির রায়হান
জহির রায়হান। একাধারে একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা। আরও
বিস্তারিত
সময়ের কবিতা
আজ শুধু কাঁদিতে চাইনা করিতে চাই চিৎকার ,  ধর্ষিতা খুনের
বিস্তারিত