উচ্চমাধ্যমিক ফাইনাল ও ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করার পরও অনেক শিক্ষার্থী সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। তাদের অবস্থা হয় অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’ রম্য নাটকের মতো। ভালোর ফলেরও এমন বিড়ম্বনা থাকতে পারে, এমন ধারণা হয়তো তরুণ শিক্ষার্থীর ভাবনায়ই আসেনি কখনও। তনিমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল ভালোই হয়েছে। মানবিক বিভাগের ইউনিটে মেধাক্রমে সে দশম হয়েছে। এই চমকপূর্ণ ফলের পরও সে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে। ভালো ফলই যেন তার কাল হয়েছে।
স্মৃতি ভেবেছিল মেধাক্রম অনুযায়ী যে বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবে, সেটাতেই পড়বে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যখন নিজের ঘাড়ে এসে পড়েছে, তখনই স্মৃতি চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাবা-মা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এ ব্যাপারে স্মৃতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার পছন্দ শেষ পর্যন্ত দুটিতে এসে ঠেকেছেÑ ইংরেজি ও ভূগোল। দ্বিমুখী ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে সে। তবে জীবনে সাফল্য পেতে হলে সঠিক সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প নেই। অনেক ভালো ফল করেও শুধু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেকে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন না। সুন্দর স্বপ্ন বিনষ্ট হয়, বাস্তবায়িত হয় না। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই জরুরি।
তবে মিসেস আলেয়ার ব্যাপারটা আবার অন্যরকম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মিসেস আলেয়া। চাকরির বয়স ২০ বছর। কাজের সূত্রেই দেশের বাইরে জার্মান অফিসে যাওয়ার সুযোগ এসেছে তার। এবারই প্রথম। অথচ দোটানায় পড়েছেন তিনি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়–য়া চৌদ্দ বছরের ছেলে রাফিকে নিয়েই তার দুশ্চিন্তা। একদিকে প্রথমবারের মতো বিদেশ সফর, অন্যদিকে ছেলেকে তার বাবার কাছে রেখে যাওয়ার টেনশন। ছেলেকে নানাবাড়িতে রেখে যাওয়ার কথাও একরকম পাকাপাকি করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু সিদ্ধান্তটা কোনোভাবেই এখনও চূড়ান্ত করে উঠতে পারছেন না।
তনিমা আর মিসেস আলেয়ার বয়সের ব্যবধান অনেক হলেও সমস্যার সূত্রটা কিন্তু একই জায়গায়। স্কুলপড়–য়া কিশোর থেকে শুরু করে অবসর নেওয়া প্রবীণ ব্যক্তি সবাই কমবেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে থাকেন। একটা ভালো সিদ্ধান্ত জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। একটা ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে সারা জীবনের কান্না। তাই সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত হতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্তই সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারে।
সিদ্ধান্তকে আমরা দুটি পাল্লায় রেখে মাপতে পারি। এক পাল্লায় ফেলা যায় ভারী সিদ্ধান্তগুলোকে, আরেক পাল্লায় হালকা বা ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলোকে। এরপর একটা ধাঁধা দেওয়া যাক। বলুন তো পাঠক, কোন পাল্লায় ওজন বেশি হবে? ভারী সিদ্ধান্তের দিকে যারা মাথা ঝুঁকাতে চাইছেন, তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি তুলা আর লোহার ওজনের ধাঁধাটা। জীবনের সেরা সিদ্ধান্তগুলো তারাই নিতে পারেন, যারা ছোট ছোট সিদ্ধান্তকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন। ‘চা না কফি’ এমন অতি তুচ্ছ জিজ্ঞাসার জবাবে যারা ত্রিশ সেকেন্ড খরচ করে ফেলেন অবলীলায়, তাদের জন্য বড় বড় দ্বিধা কাটিয়ে ওঠা মুশকিল।
জীবনের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্তকেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। এমনকি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যে-কোনো বিষয়ে বেশি ভাবলে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে।
জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কাছের মানুষের পরামর্শ নিতে পারেন। যে-কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অতীত অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা করুন। আপনার এথিকস এবং লক্ষ্যের সহায়ক সিদ্ধান্ত নিন। যে-কোনো সিদ্ধান্ত খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে মোকাবিলা করুন। সিদ্ধান্ত নিতে বললেই যাদের গায়ে জ্বর আসে, তারা বেশি বেশি করে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হোন। আপনার সিদ্ধান্ত আপনার সম্পদÑ ব্যাপারটাকে এভাবেও ভাবতে পারেন। উপযুক্ত মনে হলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রয়োজনীয় গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করুন। সবশেষে মনে রাখবেন বিখ্যাত বাংলা প্রবাদ, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। তাই ভালো করে ভেবেচিন্তে সময় থাকতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যা প্রয়োজন
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন। ‘দ্য সুনার, দ্য বেটার’ কথাটি মেনে চলুন। কারণ সময়ের মূল্য আছে।
কারও সিদ্ধান্ত নিজের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। অভিজ্ঞ লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজে যেটা ভালো মনে করবেন, সে কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিন। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হন। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে শিখুন। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অন্যের কাছে বুদ্ধি ধার না চাওয়াই ভালো। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বেলায় বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীর পরামর্শ নিন। পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিতে সব সদস্যের মতামতকে গুরুত্ব দিন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বারবার ভাবুন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে তার ভালো-মন্দের হিসাব কষতে উঠে-পড়ে লাগবেন না।
অন্যের সিদ্ধান্তে কখনও নাক গলাবেন না; তা আপনার মাথায় যতই বুদ্ধি থাকুক না কেন। সবশেষে বলা যায়, একমাত্র সঠিক সময়ে সঠিক পথ বেছে নেওয়াই আপনার স্বপ্ন সার্থক করতে পারে। আপনার জীবন সুন্দর করতে পারে। আর আপনি জীবনে সফলতার চরম শিখরে পৌঁছতে পারেন। ষ গ্রন্থনা : তনিমা রহমান