যুগ যুগ ধরে উপকূলীয় জেলাগুলোতে চাষাবাদ আমন ধানের। এই ধান চাষাবাদে অন্যান্য ধানের চেয়ে খরচও কম। তবে আমন ধান চাষের জন্য সবাই বীজতলা তৈরী না করায়, তাদের নির্ভর করতে হয় পাইকারী বাজারে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে আসা বীজের উপর। এরকমই একটি জমজমাট ধান বীজের চারার বাজার জেলার কাউখালী উপজেলা সদরের চিরাপাড়া সন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। চিড়াপাড়া বীজের নিচে জমে উঠেছে আমন ধানের চারা ভাসমান বাজার।
প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার ও সোমবার এই দুই দিন ভোর থেকেই আমন ধানের চারার হাট বসে। প্রতিহাটের দিন কাউখালীর ভাসমান আমন চারার বাজারে কয়েক লাখ টাকার আমন চারা বিক্রি হয় বলে বীজ ব্যবসায়ী ও বীজ ক্রেতারা। যদিও গত বছরের তুলনায় এ বছর আমন ধানের চারার দাম বেশি। দাম যাই হোকনা কেন অনেকটা বাধ্য হয়েই বেশি দামে চারা কিনছেন কৃষকেরা। অন্যান্য এলাকার তুলনায় কাউখালীর জমি উচু হওয়ায় এখানে জলাবদ্ধতা কম হওয়ায় বীজের উৎপাদন ভাল হয়। ফলে অনেক কৃষককেই নির্ভর করতে হচ্ছে বাজারের বীজের উপর। ওই এলাকায় আমনের বীজ সহজলভ্য হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা আমন ধানের বীজ কিনতে এ ভাসমান বীজের হাটে। আর এক্ষেত্রে শুধু পিরোজপুর নয় বরং বরগুনা, ঝালকাঠি ও মাদারীপুরের কৃষক ও বীজ ব্যবসায়ীরা এই হাটে বীজ কিনতে আসেন। পরিবহনে সুবিধার কারনে নৌকা ও ট্রলারে করে ব্যবসায়ীরা ও কৃষকরা এখানে বীজের হাটে আসেন।
পিরোজপুর কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আবু হেনা মোহাম্মদ জাফর জানান, চলতি বছরে জেলায় ৫৯ হাজার ৩৪৪ হেক্টর জমি আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হল ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৭২২ মে.টন। চাষাবাদ হয়েছে ৬১ হাজার ৭৩৮ হেক্টর জমিতে।
গত সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই চারা বেচাকেনার হাট বসেছে। কাউখালী উপজেলা এবং এর পাশ^বর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকেরা বিক্রির জন্য শত-শত নৌকায় করে আমনের ধানের চারা বাজারে নিয়ে আসছেন। শুধু কাউখালীই নয় পাশ্ববর্তী জনপধে এখন চলছে আমন ধান আবাদের মৌসুম। হাতে আর বেশী সময় না থাকায় কৃষকেরা মাঠে পরিচর্যা করে চারা লাগানোর জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আমন মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং প্রায়ই যোগার গোনে জোয়ারের পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় বীজতলা ডুবে যেয়ে বেশ ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের। তাই উপযুক্ত সময়ে চারা উৎপাদন করতে পারেননি তারা। কিন্তু এতসব প্রতিকূলতা কাটিয়ে এ অঞ্চলে নতুন উদ্যোমে শুরু হয়েছে আমনের চাষাবাদ। অসংখ্য কৃষক আমন ধানের চারা কিনতে ছুটে আসছেন সন্ধ্যা নদীর তীরে চারার হাটে।
কাউখালী উপজেলার বেশিরভাগ জমি এ জেলার অন্য এলাকার চেয়ে উঁচু ও নদীবেষ্টিত হওয়ায় এখানে একরকম জলাবদ্ধতা নেই। সে কারণে বীজতলাও তেমন নষ্ট হয় না। অন্য এলাকার কৃষকেরাও আমন ধানের চারার সংকট থেকে কাটিয়ে উঠতে এবং কাউখালীর স্থানীয় আমনের চারা ভালো মানের ও লম্বা বেশি হওয়ায় ভিড় করেন এই হাটে। কাউখালী চারার হাট থেকে ভান্ডারিয়া, নাজিরপুর, নেছারাবাদ, রাজাপুর, ঝালকাঠী, পিরোজপুর সদর উপজেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ধানের চারা কিনে নিয়ে যান। এখানে আমন ধানের চারা প্রতি পোন (৮০ মুঠো) মূল্য আটশ’ থেকে ১২শ’ টাকা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। নেছারাবাদ উপজেলার কৃষক আব্দুল গফার বলেন, তবে এ বছর বীজের মূল্য চড়া। গত বারের তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশী মূল্যে এবার ধান চারা বিক্রয় হচ্ছে।
জেলার নাজিরপুর উপজেলার শেখমাটিয়া ইউনিয়নের বুইচাকাঠী থেকে চারা কিনতে আসা কৃষক মো. নিজাম হাওলাদার বলেন, আমন চাষের জন্য বীজতলা তৈরির বীজ-ধান সংগ্রহ করা, তা দিয়ে বীজতলা তৈরি করে চারা উৎপাদনে বেশী সময় লাগে। তাই কৃষকেরা এই হাটে এসে প্রয়োজনীয় চারা কিনে নিয়ে জমিতে রোপণ করেন।
চারা কিনতে আসা পার্শবর্তী ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর উপজেলার কৃষক মৃণাল কান্তি রায় বলেন, এখন ধানের জমি চাষ করতে বদলা(দিনমজুর) পাওয়া যায় না। আর পাওয়া গেলেও তাদের দৈনিক মজুরি ৬০০/৭০০ টাকা দিতে হয়। বীজতলা তৈরি না করে বরং চারা কিনে চাষাবাদ করলে খরচ অনেক কম হয়।
পিরোজপুর সদর উপজেলার থেকে আসা কৃষক মো. সাইফুল ইসলাম কাজী বলেন, আমাদের এলাকার জমি নিচু। এজন্য জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তাই, সময়মতো বীজতলা তৈরি করতে পারি না। এই হাটের চারাগুলো লম্বা ও ভালো মানের। তাই, সবসময় এখান থেকে চারা কিনেই জমিতে রোপণ করি।
কাউখালী কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আমন মৌসুমের স্থানীয় আমন ও উফশী জাতের আমন মিলিয়ে ৪ হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে বীজের আবাদ হয়েছে। তলা তৈরী করে কৃষক। পরিপুষ্ট চারায় এবার কৃষকরা ভাল ফলনের আশা করছেন। কাউখালী উপজেলায় ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমির বীজ স্থানীয় কৃষক ক্রয় করে চাহিদা মিটায়। বাকী ২ হাজার ৩০০ বিঘা জমির বীজ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক ও ব্যাবসায়ীরা পাইকারী ক্রয় করে নিয়ে যায় বলে জানিয়েছে কাউখালী কৃষি অফিস।
কাউখালী উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আলী আজিম শরীফ বলেন, এই এলাকার জমি একটু উঁচু ও নদীবেষ্টিত হওয়ায় পানি জমতে পারে না। তাই এখানকার কৃষকেরা সময়মতো আমন ধানের চারার বীজতলা তৈরি করতে পারেন। কাউখালীর আমন ধানের চারা ভালো ও লম্বা হওয়ায় পোকামাকড়ের আক্রমণও কম হয়। তাই, কৃষকদের কাউখালীর আমন ধানের চারার প্রতি আগ্রহ বেশি। তিনি বলেন, উপকুলীয় অঞ্চলে আমন চারার সংকট চলছে। তবে কাউখালীতে এ সংকট নেই। এখানে এবার ভাল বীজ উৎপাদন করেছেন কৃষক। তাছাড়া এখানে বাণিজ্যিকভাবেই কৃষক আমন চারা উৎপাদন করছেন।