উন্নয়ন আর পরিবেশ রক্ষা- দুটি কি একই সাথে সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তবে কোনটি বেশি জরুরি? দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন নাকি সুস্থ পরিবেশ? এসব প্রশ্নের সমাধানের আগে আমি একটা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।
ধরুন কোন ব্যক্তির যক্ষা হয়েছে, এজন্য তার ওজন কমতে লাগলো, চেহারা খারাপ হতে লাগলো। এক্ষেত্রে তিনি কী করবেন? তার চেহারার উন্নতি সাধনের জন্য কৃত্রিম মেকাপ করবে নাকি যক্ষার চিকিৎসা নেবেন? এর উত্তরটা বেশ কঠিন বলে মনে করছি না। প্রকৃতির উপাদান গুলো একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর একটি উপাদান ক্ষতিগ্রস্থ হলে তার প্রভাব পুরো পরিবেশের উপর পরে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আর ভারসাম্য না টিকলে উন্নয়নের অবকাঠামোর টিকিয়ে রাখা মুশকিল। একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা কিছুতেই পরিবেশের ক্ষতি করে নয়।
বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য সুন্দরবন সৃষ্টিকর্তার রহমত স্বরূপ। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি যা ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের প্রায় ৬০ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে এবং আর বাকিটা ভারতে।
সিডর, আইলা, বুলবুল, ফনি, আম্পান ইত্যাদি নামক সকল ধেয়ে আশা ঘূর্ণিঝড় সাথে সুন্দরবন লড়ে যাচ্ছে বহুযুগ ধরে। বিনিময়ে কী পেল? আমারা কি আদৌ এ বনটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সোচ্চার? নাকি ১৪ ই ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস নিয়ে নাম মাত্র মানব বন্ধন আর কয়েক দফা দাবির মাধ্যমে আমরা আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য সব শেষ করে দিচ্ছি। ২০২০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন রক্ষাকারী কমিটি নয় দফার দাবি উত্থাপন করে। এগুলো হল- (১) উজানের বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সফল আলোচনার মাধ্যমে সুন্দরবনের জন্য মিঠা পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। (২) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাতিল করতে হবে। (৩) সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী নির্মাণাধীন পরিকল্পিত সরকারি-বেসরকারি সব প্রকল্প স্থাপনা নির্মাণ অবিলম্বে বন্ধ, বাতিল ও অপসারণ করতে হবে। (৪) বনের পাশ ঘেঁষা সব শিল্প ও আবাসন প্লট বাতিল করতে হবে। (৫) অপরিকল্পিত গাছ কাটা, পশুপাখি হত্যা ও মাছ ধরা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। (৬) সুন্দরবনের মধ্যকার নৌ চলাচল হ্রাস, নৌ দুর্ঘটনা প্রশমন, সুন্দরবনের নদীতে ডুবে থাকা নৌযান অপসারণ করতে হবে। (৭) সুন্দরবনে পর্যটন সংখ্যা সীমিত করতে হবে, জলাধার দূষণ ও চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। (৮) সুন্দরবন নির্ভর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক শিক্ষা এবং প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রকৃতির জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। (৯) বন বিভাগের জনবল বাড়ানো ও তাদের কাজের পরিধি, একাগ্রতা, সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
এই নয় দফা দাবি আদৌ সরকারের নজরে এসেছে কিনা অথবা এ দাবি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা এখনো এক রহস্যভরা গোলক ধাঁধার মত। যার সমাধান করতে হয়ত বছর পেরিয়ে নতুন বছর এসে যাবে, আবার কয়েক দফার যোগ বিয়োগ ঘটিয়ে পরিবাশবাদী সংগঠনগুলো রাস্তায় দাড়াবে।কয়েকটি খবরের হেডলাইনের মাধ্যমে আর কিছু হতাশা নিয়ে দিন গড়াতেই সবাই ভুলে যাবে সব। বন বিভাগের দুর্নীতি সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত। প্রতি বছর অসাধু কাঠ ব্যাবসায়ীদের বন কেটে উজার ও ঘুর্নীঝড় ঠেকাতে গিয়ে সুন্দরবন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ সব ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমাতে ও নতুন করে আরো বনায়ন সৃষ্টি করতে সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাপক কম।
সংবিধানের ১৮(ক) তে বলা আছে “ রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন”। এর উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়েছে প্রায় দেড়শত এর অধিক পরিবেশ আইন। পাশাপাশি রয়েছে হাইকোর্টের বহু আদেশ।কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের প্রয়োগ যথাযথ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৫(১) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের বাইরের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) বা লক্ষ্মণরেখা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই চিহ্নিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিবেশদূষণকারী শিল্পকারখানা স্থাপনে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করা একটি নীতিবহির্ভূত অন্যায় কাজ। তবুও এই আইন লঙ্ঘন করে তৈরী হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা। তার উপর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। সরকার ইউনেস্কোকে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থান ৭০ কি.মি এর বাইরে দেখালেও সরকারি দলিল দস্তাবেজ মোতাবেক, সুন্দরবন থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। বাফার জোন ধরলে যা মাত্র চার কিলোমিটার। যে ভারতের সাথে চুক্তি সম্পাদন হয়েছে সেই ভারতে অনেক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে যেখানে আইন হয়েছে এই দূরত্ব কমপক্ষে হতে হবে ২৫ কিলোমিটার।
সুতরাং রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিসন্দেহে সুন্দরবনের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল শক্তির আধার হল কয়লা যা বায়ুদূষনের জন্য দায়ী আর এ কয়লা জাহাজের মাধ্যমে সুন্দরবনের ভেতরের জলাভূমি ব্যবহার করে আনা নেওয়া করা হবে। ফলে যে কোন ধরনের জাহাজ দুর্ঘটনা সুন্দরবনের বিপুল ক্ষতির কারন হতে পারে। রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতি বর্ননা করতে আমরা উদাহরণ স্বরূপ বড়পুকুরিয়ার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র টানতে পারি। প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে বড়পুকুরিয়ার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়তন রামপালের ১০ ভাগের এক ভাগ। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ দৃশ্য। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশের কৃষিজমি কয়লা দূষণের ফলে কালো রঙ ধারণ করেছে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে গেছে, বিদুৎ কেন্দ্রের ছাই পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে।
ছাইয়ের পুকুর থেকে নালার মাধ্যমে নির্গত পানি নিকটস্থ নদী ও জলাভূমি দূষিত করছে আর পানির বিশেষ গন্ধের জন্য স্থানীয়দের কাছে তা ‘কেরোসিন পানি’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহতার ধারনা করা যায়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র মাটি, বায়ুও পানির পাশাপাশি শব্দ দুষনের জন্যও দায়ী যা বনে বসবাস রত পশুপাখির স্বাভাবিক জীবন যাপন বিনষ্ট করে, ফলে বিলুপ্ত প্রায় পশুপাখির বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শত শত কোটি টাকা খরচ করে দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃত্রিম বাধ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ভাবেই সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে এমন বাঁধ পেয়েছে।
সুতরাং, আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ সুন্দরবন রক্ষায় নিজ অবস্থান থেকে উদ্যোগ গ্রহন করা এবং সরকারের উচিৎ উত্থাপিত নয় দফার উপর গুরুত্ব দেয়া। মনে রাখতে হবে প্রকৃতি স্বভাবে খুব জেদি। এর বিপক্ষে গিয়ে করা কোন কাজই সুফল বয়ে আনে না, বরং প্রকৃতি তা ফিরিয়ে দেয় প্রতিশোধের রুপে।
ইনতিশা, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস