বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২০

তামাক ও নিকোটিন থেকে তরুণদের বাঁচাও

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস আজ ৩১ মে ২০২০। ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ ও এর সহযোগী সংস্থা সমূহের উদ্যোগে ‘বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ তামাক কোম্পানীর কূটচাল রুখে দাও, তামাক ও নিকোটিন থেকে তরুণদের বাঁচাও’। এবছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে তামাক কোম্পনির মুখোশ উন্মোচন করা এবং সব ধরনের তামাকপণ্য থেকে যুব সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এই দিবসটি তামাক ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেয়া।

তামাক কোম্পানি গুলোর মুল টার্গেট শিশু, কিশোর ছাড়াও যুব সমাজকে তামাক ও ধূমপানে আসক্ত করার পাশপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। টোব্যাকো এটলাস-২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে এক লাখ ৬০ হাজার ২০০ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটে।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের এক জরিপের দেখা যায় শতকরা ৯০.৬ ভাগ স্কুল ও খেলার মাঠের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। আবার শতকরা ৬৪.১৯ ভাগ দোকানে ক্যান্ডি, চকলেট এবং খেলনার পাশে তামাকজাত দ্রব্য রেখে বিক্রি করতে দেখা যায়। শতকরা ৮২.১৭ ভাগ দোকানে তামাকের বিজ্ঞাপন এবং শিশুদের দৃষ্টি সীমানার মধ্যে শতকরা ৮১.৮৭ ভাগ দোকানে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন হয় বলে ঐ জরিপে উঠে আসে। তামাক কোম্পানি গুলো সুকৌশলে তামাক শিশু ও যুবকদের সামনে তুলে ধরে। এর মূল কারণ তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটানো। তাই এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিপাদ্য বিষয়টি অত্যন্ত সময়োাপযোগী ও তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তব সম্মত।

বিভিন্ন গবেষনায় প্রতীয়মান, তামাক কোম্পানীগুলো ব্যবসা প্রসারের জন্য তরুণদের মাঝে ধূমপান ও তামাক সেবন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কলা কৌশল অবলম্বন করেছে যেমন ফ্রি সিগারেট বিতরন, ব্যাটেল অব মাইন্ড, উপহার সামগ্রী বিতরন ইত্যাদি। এছাড়া তারা আইনের প্রয়োগকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। তাই তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তামাক কোম্পানির মুখোষ উন্মোচন জরুরী। তামাক নিয়ন্ত্রণের এই পর্যায়ে তামাক কোম্পানির সহোযোগীদেরও মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। যাতে জনগণ এই জনস্বাস্থ্যের এই অশুভ শক্তিকে চিহ্নিত করতে পারে।

এছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরও কঠোর হওয়া জরুরী। তামাক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা প্রসারের অপকৌশলকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এফসিটিসি স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করেছে তাই এফসিটিসি ও এর আর্টিকেল ৫.৩ ও অন্যান্য আর্টিকেলসমূহ প্রতিপালন করা সরকারের দায়িত্ব। এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩- তে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত রাখার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তামাক কোম্পানির প্রতারণামূলক সকল কার্যক্রম বন্ধের পাশাপাশি কঠোর মনিটরিং অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তামাক কোম্পানির কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে কিছুটা হলেও আমরা সফল হবো।

এছাড়া কার্যকর কর ও মূল্য বৃদ্ধির পদক্ষেপের অভাবে বাংলাদেশে তামাকপণ্যের দাম অত্যন্ত কম। ফলে দেশের তরুণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী খুব সহজেই তামাক ব্যবহার শুরু করতে পারে। তাই আসন্ন বাজেটে কার্যকর করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম জনগণ, বিশেষ করে তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।

বিগত দিনে দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এফসিটিসি স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর, আইন ও বিধিমালা প্রনয়ন এবং আইন সংশোধন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক অর্জন রয়েছে। জনস্বার্থে দেশেআইন ও বিধিমালা প্রণীত হলেও কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন আরো পদক্ষেপ গ্রহণ।

করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ কোভিড ১৯ মানুষের শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে ও একটা পর্যায়ে শ্বাসতন্ত্রকে অকার্যকর করে দেয়। এজন্য বিজ্ঞানীরা বলছেন শ্বাসতন্ত্রকে রক্ষার সতর্কতা অবলম্বন করে সবাই এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে। করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ কোভীড ১৯ প্রতিরোধী ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ হল শ্বাসতন্ত্র। আমাদের শরীরের ফুসফুস শ্বাসের সঙ্গে যে সব দূষিত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে তাদের শরীর বাইরে বের করে দিয়ে ফুসফুসকে সচল রাখার চেষ্টা করে। ফুসফুসকে সুস্থ রাখার বিষয়ে তামাকজাতদ্রব্যের ব্যবহার ত্যাগ করার একটা বড় ভূমিকা আছে।

এছাড়া ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) এক গবেষণা বলছে, দিনে একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। স্ট্রোক বা মস্তিস্কে ক্ষরণের ঝুঁকিও বাড়ে ৩০ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরো বেশি, ৫৭ শতাংশের মত। কোভীড ১৯ কারণে কিছু দেশে অতিরিক্ত ধূমপায়ীদের মধ্যে ধূমপানের মাত্রা কমানোর একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তারা মনে করছেন এতে তাদের ঝুঁকি কমছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ধূমপান কমানো নয় ধূমপান একবারে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

বিশ্বের তামাক ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো অন্যতম। তামাকের ব্যবহার ও অন্যান্য কারনে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপও দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে হৃদরোগে কারনে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের, ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশের, ফুসফুসে যক্ষার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশের এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য ধূমপান দায়ী।

তামাকখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়। এভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। আর এই করোনাকালে তামাক কোম্পানির অপ্রতিরোধ্য বানিজ্যিক কৌশল ধূমপায়ী বা তামাকসেবীদের করোনা আক্রান্তের ঝুকি অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এবিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতের কোন অমিল নেই।

এই পরিস্থিতিতে মহামারি চলাকালীন জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সকল তামাকজাতদ্রব্য বিপণন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে তামাক বিরোধী সংগঠন গুলো। তামাক কোম্পানির প্রচারনা ও করোনা আবহে ধূমপান নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা সোশ্যাল মিডিয়ায়সহ অন্যান্য মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ধূমপান নিয়ে সেইসব ভুল ধারণা আমল দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।

তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় তামাক জনিত ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর হার কমানোর জন্য যে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা জরুরী। এক্ষেত্রে আমরা সাধারণ ভাবে যা দেখি তাহলো তামাক কোম্পানিগুলো অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের আনুকল্য পেয়ে আসছে। যা সুস্পষ্ট ভাবে আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলছে। একদিকে তামাক কোম্পানির বেপরোয়া মনোভাব, তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা, নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য বিশেষ কর্মকৌশল না থাকা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ জাতীয় নীতি প্রণয়ন না করা ইত্যাদি বিষয় গুলো তামাকের কার্যকর নিয়ন্ত্রণকে ব্যাহত করেছে।

এমতাবস্থায়, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে বিদ্যমান আইনের সঠিক বাস্তবায়ন এবং সকল পর্যায়ে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। বিশ্ব নেতারা এই মুহুর্তে অর্থনীতির চেয়ে মানুষের জীবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় পৃথিবীর বহু দেশ এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যকে বেশি গুরুত্ব¡ দিচ্ছে। অর্থনীতির বিবেচনায় যাই হোক, এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাই মহামারির এই পরিস্থিতিতে তামাক কোম্পানিগুলো উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে সরকারের দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।


ইকবাল মাসুদ, পরিচালক, স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।


বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা
৭ই জুন ৬-দফা দিবস হিসেবে আমরা পালন করি। ২০২০ সাল
বিস্তারিত
মোহিত কামালের টুকরো গল্প ‘উপকার’
একা একা ঘাস আর গাছের  কচি কচি লতাপাতা খাচ্ছিল জেব্রা।
বিস্তারিত
রক্ত জমাট বাঁধা: করোনায় মৃত্যুর
পঞ্চাশ বয়সের একজন ভদ্রলোক হাসপাতালে ভর্তি হন কভিড ১৯ পজিটিভ
বিস্তারিত
উন্নয়ন আর পরিবেশ রক্ষা, দুটি
উন্নয়ন আর পরিবেশ রক্ষা- দুটি কি একই সাথে সম্ভব? যদি
বিস্তারিত
করোনা প্রতিরোধে অন্তরের অসুখ নিরাময়
মানুষের অসুস্থতা প্রধানত দুই প্রকার, শারীরিক ও মানসিক। বিশ্বস্বাস্থ সংস্থা
বিস্তারিত
আমাদের চার পাশে হাজারো দু’পায়ের
আপনি পবিত্র রমজান মাসে কতজন লোককে সাহায্য করেছেন? একজন? দুইজন?
বিস্তারিত