একদিন শাহাবাগের আড্ডায় স্টালিনকে বললামÑ তুমি মামা কবি না হয়ে নায়ক হলেই পারতা। আসলে স্টালিন লিখেছে প্রচুর, যাকে বলা হয় বহুলপ্রজ। স্টালিনের থিমকে জড়িয়ে থাকে ইতিহাস, ইতিহাসের বাতাবরণ। মিথের সংগঠনে নানা কিংবদন্তি উপকথা তো থাকেই।
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের নাম জেনেছি ৮০ দশকের শুরুতে এবং পরিচয় আরও পরে। ৮০-এর দশকের মাঝামাঝিতে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি একই দিন পাঁচ-ছয়টা পত্রিকায় স্টালিনের কবিতা প্রকাশ হয়েছে। সে ঢাকা আসার পর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। একদিন শাহাবাগের আড্ডায় স্টালিনকে বললামÑ তুমি মামা কবি না হয়ে নায়ক হলেই পারতা। আসলে স্টালিন লিখেছে প্রচুর, যাকে বলা হয় বহুলপ্রজ। স্টালিনের থিমকে জড়িয়ে থাকে ইতিহাস, ইতিহাসের বাতাবরণ। মিথের সংগঠনে নানা কিংবদন্তি উপকথা তো থাকেই। তার পঞ্চাশ বছরে বেরিয়েছিল ‘আদিম’-এর একটি বিশেষ সংখ্যা। এর সম্পাদকীয়তে সম্পাদক বলেছেনÑ ‘স্বতন্ত্র চরিত্রের অধিকারী রেজাউদ্দিন স্টালিন কবিতায় প্রতিস্থাপন করেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, মানুষের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস। ঐতিহ্যের চোখ দিয়ে মানুষকে বিচার করেছেন। অমৃতের মহিমা বর্তমানের মানুষের সঙ্গে ইতিহাসের মানুষের গড়ে তুলেছেন কাব্যিক জাদুকরী সেতুবন্ধন। কাব্য ইতিহাসের মূল নির্যাসে কবি ইতবাচক দৃষ্টভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন এখানে। স্টালিনের কবিতা পড়ে মনের ভেতর একটা বিশ্বাস জন্ম নিতে পারে, একই সময়ে কবিরা সর্বকালে বসবাসের যোগ্যতা ধারণ করেন। তা না হলে শিল্প সৃষ্টি করা যায় না।’ কোটেশনের কথাগুলো আমার নিজের মনের কথা বলেই মনে হচ্ছে। প্রখ্যাত লেখক সাহিত্য সমালোচক শিবনারায়ণ রায়ের মূল্যায়ন পরিমিত ও পরিশীলিত। তিনি স্থির কণ্ঠে উচ্চারণ করেনÑ আধুনিককালে প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করার একটা গূঢ় প্রবণতা অনেকের মধ্যে আছে, তাতে করে কবিতা ও পাঠকরা মানুষের মন থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে বলে মনে হয়। স্টালিন সেই দূরত্ব ঘোচানোর জন্য কিছু কবিতা লিখেছেন। সে চেষ্টা করেছেন মিথকে বর্তমান প্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে। গ্রিক, রোমক ও ভারতীয় পুরাণ থেকে প্রাসঙ্গিক ব্যবহার তার কবিতাকে ধ্রুপদীগুণে অভিষিক্ত করেছে। তার তিথোনাসের কান্না, হারকিউলিস, নবজাতক, পৃথিবীতে ভোর হতে দেখিনি কখনো, আত্মস্বীকৃত ঘুমÑ এ কবিতাগুলো আমার ভালো লেগেছে। তার কবিতা পাঠ করলে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ করা চলে না। একটি দার্শনিক চিন্তা তার কবিতাকে আচ্ছন্ন করে থাকে, এ যুগে যন্ত্রের সঙ্গে হৃদয়ের পারঙ্গমতাকে স্বীকৃতি দিতে হয়। তার কবিতায় সেই সদ্গুণ আছে বলে তার কবিতা পড়ে আনন্দ পাই।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদ স্টালিন সম্পর্কে তার প্রজ্ঞাপূর্ণ সুচিন্তিত অভিমতে বলেনÑ ‘আমি তার কাব্য পাঠ করেছি। অনেক কাব্যবোদ্ধাও তার কবিতা পড়ে তাদের সমর্থনসূচক বক্তব্য লিখিতভাবেই উত্থাপন করেছেন। আমাদের দেশের কবিকে অকাব্যিক পরিবেশে জীবনযাপন ও জীবিকা অর্জন করতে হয়। আমাকেও করতে হয়েছে। নিজের জীবিকা অর্জনের পন্থাকে সহনীয় করে তুলতে হয়। খাপ খাইয়ে নিতে হয়। স্টালিন এ পর্যন্ত তা পেরে উঠেছেন দেখে আমি তার প্রতি আশাবাদী হয়ে আছি। কবিতা মুহূর্তের বিষয় নয়, হাততালির বিষয় নয় বরং ধীরে ধীরে দেশের মানুষের মস্তিষ্কে মননে শেকড় চারিয়ে কা- সিধা রেখে পাখা মেলে দিতে হয়। অনেক বড় কবিই তাৎক্ষণিক প্রশংসাটুকুও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। আমি মনে করি স্টালিন পাঠকের সমর্থন যতটুকু পেয়েছেন, তা নিজেকে উজ্জীবিত রাখার জন্য যথেষ্ট।’
সর্বোপরি রেজাউদ্দিন স্টালিনের চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, পঠন-পাঠন, মেধা-প্রজ্ঞা, রুচিবোধ, হৃদয়ের পূর্ণ মননপ্রভা তাকে আমাদের ভেতর ভিন্নতা দিয়েছে, করেছে আলাদা ও অনন্য।